মাহবুবুল আলম
নানান জল্পনা কল্পনা, বিভিন্ন আশংঙ্কার সমাপ্তি ঘটিয়ে ২৫ মে ২০২৩ হয়ে গেল ঢাকার উপকন্ঠ গাজিপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন এই সিটির সাবেক (বহিষ্কৃত) মেয়র জাহাঙ্গীর আলম এর মা জায়েদা খাতুন। তাকে অভিনন্দন!
আমাদের দেশের নানাবিধ ত্রুটির কারণে কোনো নির্বাচনই শতভাগ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি।আর আমাদের দেশের নির্বাচনী সংস্কৃতি হলো যেদল নির্বাচনে হেরে যায় সেইসব দলই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে। তবে আমার বিশ্বাস
গাসিক নির্বাচন নিয়ে কেউ অভিযোগ তোলতে পারবে না। ভোটার উপস্থিতি কম হলে এই নির্বাচন যে সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে তা সারাদিন টিভি চ্যানেলের সরাসরি সম্প্রচার দেখেই বোঝা গেছে। আমাদের দেশে নির্বাচনে জয়পরাজয়ে
নানান ফ্যাক্টর কাজ করে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ক্ষমতাসীনদের প্রতি সৃষ্ট ভোটারদের নেতিবাচকধারণা। হোক সেটা জাতীয় বা স্থানীয় নির্বাচন।
কেননা, ক্ষমতায় গিয়ে কেউ মানুষকে শত ভাগখুশি করতে পারে না, এর পেছনেও বহুবিধ ফ্যাক্টর কাজ করে। যা স্বল্প পরিসরে বলা সম্ভব নয়। থাক সেসব কথা। ফিরে আসি গাসিক নির্বাচনে।
জায়েদা খাতুন মেয়র পদে মনোনয়ন জমা দেওয়ার আগে রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে মোটেই পরিচিত ছিলেন না। কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও তিনি কখনো অংশ নেননি। মাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী করে তার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম যখন মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিলেন। সেই অপরিচিত জায়েদা খাতুনের কাছে জানু রাজনীতিবিদ এডভোকেট আজমত উল্লা খান হেরে গেলেন। চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা গেলো ৪৮০টি কেন্দ্রে জায়েদা খাতুন (টেবিল ঘড়ি) পেয়েছেন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট। আজমত উল্লা খান (নৌকা) পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। অর্থাৎ ভোটের ব্যবধান মাত্র ১৬ হাজার ১৯৭।
দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় আস্থার অভাবে জনমনে একটা বদ্ধমূল ধারনা জন্মেছে যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী আজমত উল্লা খানই জয়ী হবেন বা তাকে ‘জিতিয়ে আনা হবে’ কিন্তু ফলাফল হলো উল্টো, সাধারণ একজন গৃহিনী, প্রাক্তন ও বহিস্কৃতমেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা ছাড়া জায়েদা খাতুনের আর তেমন কোনো পরিচয় ছিল না। শিক্ষাগত যোগ্যতায়ও অনেক পিছিয়ে। তিনি অষ্টম শ্রেণি পাশ। একজন ফেসবুকের বন্ধু আক্ষেপ করে বলেছেন,” অষ্টম শ্রেণি পাশরাই অষ্টম শ্রেণি মর্মবোঝে” এতে এক বন্ধু মন্তব্য করে বলেছেন,” অষ্টম শ্রেণি পাশ যদি রাষ্ট্র চালাতে পারে, তবে অষ্টম শ্রেণি পাশ জায়েদা খাতুন কেন একটা সিটি কর্পোরেশন চালাতে পারবেন না” যাক কথা সেটা না কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভোটের লড়াইয়ে আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে প্রার্থী উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত প্রার্থী এডভোকেট আজমত উল্লাকে পরাজিত করে তিনি চমক সৃষ্টি করেছেন।
গাজীপুর শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এবং জাহাঙ্গীর আলম নিজেও একজন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী বলে পোশাক শ্রমিকদের অধিকাংশই তাকে ভোট দেন। এটি গাজীপুরের একটি বিরাট ভোট ব্যাংক। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও যখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, সেখানেও জাহাঙ্গীর আলম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। ওই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন এবং ভোটগ্রহণের বেশ কয়েকদিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পরেও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পান। তার মানে ভোঠের মাঠে থাকলে হয়তো তিনি ওই নির্বাচনেও জয়ী হতেন। এরপর ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর। কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য এবং মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করায় ২০২১ সালের ১৯ নভেম্বর তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে মেয়র পদও খোয়ান। পরে অবশ্য দল তাকে ক্ষমা করে দেয়। কিন্তু তিনি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এবার মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দেন। তখন তিনি তার মায়ের পক্ষেও মনোনয়নপত্র জমা দেন। কারণ তিনি নিশ্চিত ছিলেন বা ধারণা করছিলেন যে হয়তো তার মনোনয়ন বাতিল হবে। তা-ই হয়েছে এবং মাকে ডামি প্রার্থী রেখে মূলত জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচনে অংশ নিলেন।
আর এক আওয়ামীপ্রেমি যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন-জায়েদা খাতুনের প্রাপ্ত ভোট কে জাহাঙ্গীর আলমের মায়ের নয়। এই ভোট বাম অতিবাম মোশতাক লীগ, বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, জিপি (কাদের) নৌকা ঠেকাও গ্রুপসহ সম্মিলিত আওয়ামীবিরোধী জোটের ভোটের যোগফল। তবে তার কথাটা একেবারে বেঠিক বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কেননা, দেশে যখনই মার্কার নির্বাচন আসে তখন সবাই নৌকা নির্বাচনে না থাকলেও ঠেকাও জোটে পরিনত হয়। আওয়ামী লীগের মার্কার প্রতি এরা অতিরিক্ত প্রতিহিংসাপরায়ন। আওয়ামী জয়লাভ করলে এক ধরনের চুলকানি রোগে আক্রান্ত হয়
চুলকিয়ে চুলকিয়ে নিজের পাছা রক্তাক্ত করে ফেলে। চোর ডাকাত, সাজাপ্রাপ্ত আসামি সে যেই হোক তাকে জেতাতে ঠেকাও নৌকা জোট হয়ে যায়। এরা মোদির বিজয়ে মিষ্টি বিতরণ করে। পাকিদের বিজয়ে উল্লসিত হয়। মাগার আওয়ামিলীগেরকোন অর্জন তারা মেনে নিতে পারে না।
এ বিষয়ে ২৬ মে বাংলা ডট বিডি২৪ নিউজ পোর্টাল লিখেছে “সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিত লোকের শাসন বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে গণতন্ত্র আসলে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ অশিক্ষিত’ লোকের শাসন। অর্থাৎ এখনও আমাদের দেশের ভোটারদের অধিকাংশই ওই অর্থে শিক্ষিত নন। কিন্তু একজন দোকানদার বা একজন পোশাক শ্রমিকের একটি ভোটের যে দাম, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের ভোটেরও সেই দাম। মানুষ সব সময় তার নিজের লোককে ভোট দিতে চায়। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি দেখে যে কোনো একজন প্রার্থী তার জন্য অধিকতর নিকটবর্তী বা যাকে সে মনে করে যে কালাচারালি কাছাকাছি—তাকে ভোট দিতে চায়। সুতরাং নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকও একজন শ্রমিক নেতার কাছে হেরে যেতে পারেন। এটাই গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সুবিধা এবং অসুবিধা।”
গাজীপুরের পোশাক শ্রমিকরা জাহাঙ্গীর আলমের মায়ের জয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে বলে ভোটারা মনে করেন গাজীপুর শহরে প্রায় ২ হাজার পোশাক কারখানা এবং টঙ্গী ও কোনাবাড়ীতে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) ২টি শিল্প অঞ্চল আছে। এছাড়াও টঙ্গী, বোর্ড বাজার, ভোগড়া, কোনাবাড়ী, কাশিমপুরে বেভারেজ, টেক্সটাইল, কম্পোজিট, জুতা ও অ্যাপ্লায়েন্সসহ বিভিন্ন ধরনের কারখানা আছে। বেশির ভাগ শ্রমিক উত্তরের হলেও অনেকেই গাজীপুরের ভোটার হয়েছেন। ফলে, ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৮৬ জন ভোটারের একটি উল্লেখযোগ্য শতাংশ শ্রমিক। যা গার্মেন্টস ও জুট ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলমের মাকে ভোট দিয়েছেন।
শেষ করবো এই বলেই যে, অনেক দিন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলে আসছেন, তিনি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। এর আগেও বেশ কয়েকটি নির্বাচনে সরকারী দলের প্রার্থী হেরে গেছে। যার সদ্য প্রমাণ হলো গাজীপুর সিটি
কর্পোরেশনের নির্বাচন। এই নির্বাচন নিয়ে কারো কোনো অভিযোগ নেই। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অতি উৎসাহী আমলাদের কারণে রাতের ভোটের যে বদনাম হয়েছে আগামী নির্বাচনে সেই বদনাম ক্ষমতাসীন দল কাটিয়ে ওঠুক সেটাই
আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক
মন্তব্য করুন