মুহাম্মদ আবদুর রহীম চৌধুরী
বাংলাদেশ মারাত্মক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। তারজন্য কেউ কাউকে দোষারোপ না করে করণীয় যেটা সেটা না করলে দেশ শীঘ্রই ছারখার হয়ে যাবে। ভারত আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকেরা ৭০ এর নির্বাচনে নির্বাচিত বঙ্গবন্ধুর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পূর্ব পাকিস্তানকে চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। সেই সময়ে ভারত এগিয়ে না আসলে নয় মাসে দেশ স্বাধীন কখনো হতো না। স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ এর মধ্যে পজেটিভ – নেগেটিভ যা-ই ঘটুক না কেন-তারজন্য পূর্ব পাকিস্থানকে স্বাধীন হতে বাধ্য করায় প্রথমত পাকিস্তান দায়ী দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম অনৈক্যই দায়ী।
এখন পাকিস্তান বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেই- আছে ভারত। স্বাধীনতার পর বছরের পর বছর ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার কারণে বাংলাদেশের রাজনীতির খুটিনাটি সবকিছু ভারত খুবই কাছ থেকে অবলোকন করে আসছে। বর্তমানে ভারতে উগ্রবাদী দল ক্ষমতায়। ভারতের অনেকের দৃষ্টিতে এবং বাংলাদেশের কিছু লোকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশেও উগ্রবাদী রয়েছে। বর্তমান ভারতে উগ্রবাদী সরকার উগ্রবাদ উস্কে দিয়ে মেজরিটি লোকের সমর্থন নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই বারবার ক্ষমতায় আসছে। ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভিন্ন মত ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সময়ে সময়ে স্থানে স্থানে স্টিমরোলার চালিয়ে তাদের নিঃশেষ করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। শুধুমাত্র একটি রাজ্যে ছয় শতাধিক মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়াসহ অনেকগুলো মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়। কোটি কোটি মানুষকে নাগরিকত্বহীন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বুলডোজার দিয়ে বাড়িঘর গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আগুন লাগিয়ে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হাঘরে করে যাযাবর বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ভারতের বিভিন্ন শহরের অলিতে গলিতে ফুটপাতে আশ্রয়হারা মুসলমানরা মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। নারীদেরকে ধর্ষণ করা হচ্ছে। শুধুমাত্র মুসলমান -এই অপরাধে রাস্তায় প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এসব তো ফ্যাসিবাদ। ফ্যাসিবাদ কখনো থামে না। বর্তমানে যাদের পীড়ন করে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে তারা প্রায় শেষ হয়ে গেলে অন্য ধর্মের দলিত ও নিম্নবর্ণের লোকদের উপর স্টিমরোলার চালাবে, (ইতোমধ্যেই উপজাতি ও নিম্নবর্ণের লোকদের উপর আক্রমণের খবর মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে।) তারা শেষ হলে আরেক সম্প্রদায়ের উপর স্টিমরোলার চালাবে অর্থ্যাৎ তাদের জুলুম কখনো শেষ হবে না, অব্যাহত থাকবে। সর্বশেষ আপন ভাইয়ে ভাইয়ে লাগবে-এটাই ফ্যাসিবাদের ধর্ম। ফ্যাসিবাদের জুলুম থেকে আগে কিংবা পরে কারো নিস্তার নাই। আর তাই ফ্যাসিবাদ থামানোর জন্য বর্তমানে যারা আক্রমনের শিকার হচ্ছেন না, পরে তো অবশ্যই হবেন -এটা চিন্তা করে তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে। শুধু নিজে বাঁচি, নিজের দল কিংবা ধর্মের লোকদেরকে বাঁচাই-এরকম সংকীর্ণতা পরিহার করে না আগালে এক সময়ে এসে নিজের ধর্মের লোক, দলের লোক কিংবা নিজেকেও বাঁচাতে পারবেন না। আর তাই সময় থাকতে সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশ ও ভারতের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ভারতের কংগ্রেসসহ বিভিন্ন দল সোচ্চার হলেও নেতৃত্বের দূর্বলতার কারণসহ অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশকে দেখতে না পেয়ে তারা কিছুই করতে পারছেন না। আর তাই বাংলাদেশকে অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী দেশে পরিণত করতে হবে।
১৯৪৭ এ হিন্দু-মুসলিম তথা ধর্ম হিসেবে দেশ ভাগ হয়েছিল এটা বলে বিজেপি ভারতের কোনো মুসলিমকে ভারতে থাকতে দিতে রাজী নয়। বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলো শীঘ্রই ক্ষমতায় আসছে-এরকম প্রপাগাণ্ডা ভারতের বিজেপি সমর্থিত সাংবাদিকসহ কিছু নেতা তাদের দেশে অহরহ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুসলিমরা তাদের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন করার দ্বারপ্রান্তে আসতে পারলে আমরা কেনো হিন্দুত্ববাদ ভারতে কায়েম রাখতে পারবো না। এভাবে বলে সাধারণ হিন্দুদের সমর্থন বিজেপি ব্যাপকভাবে পেয়ে আসছে।
বাংলাদেশের তিনদিকে যেমন ভারত রয়েছে তদ্রূপ ভারতের তিনদিকেও বাংলাদেশ রয়েছে।
বাংলাদেশ কখনো ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে যাতে না দাঁড়ায় -তারজন্য ভারত সবসময় পেরেশানিতে থাকে। ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালানের সাথে বাংলাদেশ সম্পৃক্ত থাকায় ভারত সেটার প্রতিশোধ নিয়েছে -ইন্ডাইরেক্টলি প্রণব মুখার্জি তার বইয়ে তা লিখেছেন। বাংলাদেশের এমনকিছু করা কখনো উচিত হবে না-যাতে ভারতের অখণ্ডতা হুমকির মুখে পড়ে অন্যদিকে ভারতেরও এমন কিছু করা উচিত হবে না-যাতে বাংলাদেশ ক্ষতির মুখে পড়ে।
কুমিল্লায় মূর্তির বেদীতে কোরআন রাখার কান্ডে ভারতেও দাঙ্গা শুরু হলে শেখ হাসিনা ভারতকে কঠোর ভাষায় কথা বললে ভারতের দাঙ্গা তখন থেমে যায়। মোদি সরকার তা থামাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। অতীতে কোনো সময় শেখ হাসিনা ভারতকে এরকম সতর্ক করেননি। করতে পেরেছেন এজন্যই যে তিনি বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা ভারসাম্যের স্থানে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু এখন শেখ হাসিনা তার ও তার দলের অস্তিত্বের স্বার্থে সেই ভারসাম্যের স্থান থেকে দেশকে সরিয়ে নিয়ে আনতে পারে-এরকম আলামত দেখা যাচ্ছে -তখন দেশের সমূহ ক্ষতি হয়ে যাবে। বাংলাদেশের বৃহৎ বিরোধীদল বিএনপি শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিলে দূর্নীতি-অনিয়ম বন্ধ না হলেও দেশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির খপ্পর থেকে বেঁচে যেতো। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপিই ক্ষমতায় আসবে-আওয়ামীলীগ সুষ্ঠু নির্বাচন না দেওয়ায় বিএনপি কখনো আওয়ামীলীগকে সমর্থন দিবে না। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে সরকারী দল ও বিরোধী দল সবসময় দেশের স্বার্থে এক সুরে কথা বলে। এদিকে জনসমর্থন তেমন না থাকায় এবং ক্ষমতা হারালে চরম প্রতিশোধের মুখে পড়তে হবে-এটা ভেবে সুষ্ঠু ইলেকশন না দেওয়াসহ ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ভারসাম্যপূর্ণ স্থান থেকে দেশকে সরিয়ে দেশের সমূহ ক্ষতি করতেও আওয়ামীলীগ দ্বিধা করবে না। আওয়ামীলীগ ও বিএনপি জোট মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্যদিকে বাংলাদেশ যেকোনো একটি শক্তিধর দেশের কাছে বিলীন হওয়ার সম্ভাবনা। উক্ত দুই সমস্যা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে
আওয়ামীলীগ ও বিএনপি জোট, উক্ত দুই জোটের লোকদের থেকে মোটামুটি সহনশীল লোকদের নিয়ে তৃতীয় একটা শক্তি সৃষ্টি করা অপরিহার্য। ভারতে বাংলাদেশের চেয়ে বেশী মুসলমান রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি ভারতের অভ্যন্তরে এবং ভারতের রাজনীতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নেগেটিভ কিংবা পজেটিভ প্রভাব ফেলে। পজেটিভ প্রভাব উভয় দেশের জন্য সুখকর কিন্তু নেগেটিভ প্রভাব কোনো দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। আর তাই বাংলাদেশের রাজনীতির তৃতীয় শক্তিকে দেশের আত্মমর্যাদা ও স্বকীয়তা ঠিক রেখে আন্ত:রাষ্ট্রীয় সম্প্রীতির বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। তবেই ৩য় ধারাটি সফল হবে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ৩য় শক্তির দল ক্ষমতায় আসলে সেই দল কর্তৃক আইনের শাসন, উন্নয়ন ও সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা গেলে ভারতের কট্টরপন্থী বিজেপি তা দেখে তাতে তাদের ভুল বুঝতে পেরে তারাও চরমপন্থা থেকে সরে আসবে এবং ভারতের কংগ্রেসসহ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দলগুলো অনুপ্রাণিত হবে এবং এদের সমর্থন বৃদ্ধি পেয়ে ভারতও ফ্যাসিবাদ থেকে সরে এসে ভারতেরও সবাই অশান্তি থেকে বেঁচে যাবে।
আমরা বাংলাদেশীরা যদি আমাদের ভাল চাই তাহলে আমাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টিকারীদের ও ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের বিভক্তি সৃষ্টির বিপরীতে সর্বজনীন ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। যদি ভারতের আধিপত্য ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়তে হয় তাহলে বাংলাদেশকে অবশ্যই ভারতের হিন্দুত্ববাদ বিরোধী জনসাধারণকে বন্ধু হিসেবে পেতে হবে। বাংলাদেশে যদি আমরা সর্বজনীন তথা সর্বধর্মীয় ঐক্য গড়ে ক্ষমতায় যেতে পারি তাহলে ভারতের হিন্দুত্ববাদ বিরোধী সব জনগণই বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবে।
বাংলাদেশের জনগণকে এটাও বুঝতে হবে এই বন্ধুত্ব বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্যও অপরিহার্য।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ ভারত বিরোধী এটা ভারত ভালো করেই জানে আর তাই ভারত নিরাপত্তার স্বার্থে দেশের দূর্বল সরকার থেকে ৫২ বছর ধরে সুবিধা আদায় করে আসছে। দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রুপ পেলে কোনো সরকারই দূর্বল সরকারে পরিণত হতো না এবং বিদেশি কোনো রাষ্ট্রও অন্যায্য সুবিধা আদায় করতে পারতো না। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতার কারণেই ভারত সুযোগ পেয়ে আসছে-তারজন্য ভারতকে দায়ী না করে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের সংশোধন হওয়াটাই জরুরি। ভারত বিদ্বেষ থেকে বাংলাদেশের জনগণকে সরে আসতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ এর লিখা সঙ্গীত আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। পছন্দ করেন বা না-ই করেন এই সঙ্গীত বায়ান্ন বছর ধরে দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। এই ক্ষেত্রে সঙ্গীতের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ এখনও আমাদের সম্পর্কের যোগসূত্র। রবীন্দ্রনাথকে বাড়তি ভক্তি যেমন বন্ধ করতে হবে, তেমনি একচেটিয়া রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতার আত্মঘাতী পথও আমাদের পরিহার করতে হবে।
নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবাদ যেমন করতে হবে অন্যদিকে তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তারা যে কখনো বিদেশীদের দ্বারস্থ হয় না-তাদের এইগুণকে প্রশংসাপূর্বক তাদের এই গুণকে বাংলাদেশে শতভাগ কার্যকর করতে হবে।
আমরা কোনো একজন ব্যক্তি, দল, ধর্ম কিংবা দেশের পজেটিভ কিংবা নেগেটিভ শুধু এক সাইড বলি-উভয় সাইড তথা ভালো-মন্দ দুইটি একসাথে না বলে সেই ব্যক্তি, দল, ধর্ম কিংবা দেশকে অতিরিক্ত প্রশংশায় ভাসিয়ে দেই কিংবা অতিরিক্ত শত্রুতে পরিণত করে দেই- তা মোটেও ঠিক নয় আর তাই মেরিট-ডিমেরিট উভয় দিক যুগপৎভাবে আলোচনায় আনাটাই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়।
মসজিদের পাশে আমায় কবর দিও ভাই যেনো গোরে থেকেও মুয়াজ্জিন এর আজান শুনতে পাই-এরকম মন-মানসিকতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ও অনৈক্যের কুফল বুঝতে পেরে, মোরা একটি বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান এরকম কথা লিখে হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহবান জানিয়েছেন। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানির পরিবর্তে সম্প্রীতি ও ঐক্যের চাষবাস করা না হলে পুরো উপমহাদেশ শীঘ্রই নরক রাজ্যে পরিণত হয়ে যাবে।
মুহাম্মদ আবদুর রহীম চৌধুরী
প্রতিষ্ঠাতা
বাংলাদেশ ঐক্য পার্টি
মন্তব্য করুন