joyosree Mohan Talukder
মা সন্ধ্যা প্রদীপ হাতে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকতেই শুনতে পেল আমার আর আমার ছোটরকাকুর কথা। বাগানে চাকুরি করে আমার ছোটকাকু। কি চাকুরি করত আমার কাকু এখন ও আমরা কেউ জানি না সেই ভাবে।তবে শুনেছি চা ফ্যাক্টরির অফিসে হিসাবের চাকুরি করত।উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছে আমার কাকু।তবে অনেক টাকা করেছে বাগানে চাকুরি করে। আমার মা কাকুর বাগানে চাকুরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। শুনেছি মায়ের কারনেই এই চাকরি।কাকু দামীগাড়ী ছাড়া কখন যাতায়াত করত না। খুব সৌখিন ছিলেন আমার কাকু। সবার বিপদে এগিয়ে আসত সবার আগে। কিন্তু কেন জানি জেঠুর সাথে মন থেকে মিশতে পারত না। কিছু টা দুরত্ব থেকেই যেত।
আমার বাবা কলেজে চাকরি করে। মা ও বাবার দুজনের আয়তে আমাদের সংসার চলে। সেখানে কাকু বাগানে চাকুরি করে দামী গাড়ী, সুন্দর বাড়ী দুই মেয়ে সহ পরিবার নিয়ে কাকি ঢাকা শহরে বসবাস করে। পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাকু বাসায় আসে। কাকুর চাকুরির কর্মস্হল সিলেটের একটি প্রসিদ্ধ চা বাগান। ছুটির দিন গুলোতে কাকু পরিবারের মানুষ ছাড়া একদম থাকতে চাইত না।
বাগানে শ্রমিকের সাথে কাকুর অনেক ভালো সম্পর্ক ছিল।
সবাই তাঁকে বাবু করে ডাকত।। কি জানতে চেয়েছিল সেদিন নিবারন জেঠু কাকুর কাছে থেকে যার জন্য এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে আমাদের পরিবারে। মা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। বাবা সবাইকে বুঝাতে চেষ্টা করে।কিন্তু……..
আমাদের পরিবারে আমি একমাত্র ছেলে। বড় জেঠু ও কাকুর ঘরে কোন ছেলে নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ে আমি কাকুর ঢাকার বাসায় কিছুদিন ছিলাম।সেই সময়ে দেখেছি কাকু ও কাকিমার মধ্যে কেমন যেনি একটা দুরত্ব থাকে।কাকিমা কাকুর দিকে মুখ তুলে কথা বলেনা। কাকু সবার শেষে একলা রাতে বসে ভাত খায়।
খুব একটা স্বচ্ছল পরিবারে কাকু বিয়ে করতে পারেনি জন্য আমার জেঠুরৃ খুব একটা খুশী ছিল না কাকুর উপর। পুর্ব পরিচয়ে তাদের বিয়ে হয়েছিল। নিজের বাবা মা ভাইবোনদের প্রতি কাকিমার প্রচন্ড টান ছিল।প্রতিমাসেই টাকা পাঠানো হতো কাকুর মাসিক আয় থেকে।
মনে আজ কতো চিন্তা বাবার। সকাল থেকে বাবাও জেঠু একদম ভালো নেই। শুধু কাকুর কথা বলছে। কি করবে তারা এখন। সব পথ বন্ধ। এই জটিলতা থেকে বের হয়ে আসতে হলে পরিবারের সবাই কে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। আমি কি তাদের কোন সাহায্য করতে পারব?।মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় আমার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ। কি মানসিক কষ্টের মধ্যে পড়েছে পরিবারের সবাই তা আমার বাবাও জেঠুকে দেখলে বুঝতে পারা যায়।
বাবা আদর করে কাকুকে ডাকত সূর্য। কি সুন্দর করে কথা বলত কাকু। মাও কাকুর সম্পর্ক ছিল খুব ভালো। বাবা কাকুকে সন্তানের মতো ভালোবাসত।কাকু বলত বাবাকে বরদা আমি যদি কখনও হারিয়ে যাই তবে আমার ছোট মেয়ে দুটোকে তুমি বড় করো । মানুষের মতো সানুষ করো।
আমি বুঝতে পারতাম না কাকু কেন এগুলো কথা বলে।
বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। আমি সে দিন হল থেকে কাকুর বাড়িতে গিয়েছিলাম ছোটবোন টুম্পার জন্মদিন উপলক্ষে। অনেক রান্না করেছে কাকিমা।বেলুন দিয়ে সুন্দর করে মোহাম্মদ পুরের সুন্দর বাড়িটি সাজিয়েছি আমরা।রাত ঠিক তিনটার দিকে কাকুও কাকিমার মধ্যে প্রচন্ড আওয়াজ করে ঝগড়া শোনা যাচ্ছিল।জানি না কি হয়েছিল সেই রাতে। শুধু সাগর নামে একটি ছেলেকে কেন্দ্র করে গন্ডগোল যে চলছিল তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। পরে জানলাম সাগর গৃহ শিক্ষক আমার বোনদের।
সাগরের কারনেই রুম্পা ও টুম্পা পড়াশোনা প্রতি বেশ খুব আগ্রহী ছিল। বাগানে এসে তারা থাকতে চাই তো না।
কাকু ছুটি নিয়ে ঢাকায় গিয়ে সন্তানদের নিয়ে থাকতেন।
সাগর নামের এই ছেলেটি ঢাকার গাজীপুরে থাকত।
কাকিমার বাবা গাজীপুরের একটি কলেজ চাকুরি করতেন।অনেক আগে থেকেই কাকিমা চিনতেন সাগর কে।
সাগর নামের সেই ছেলেটি ও আমার কাকিমা একই কলেজে পড়তেন। বয়সে দু একবছরের ছোটবড় তঁারা।পারিবারিক অনেক বিষয় কাকিমা সাগরের কাছে গল্প করতেন যেটা কাকু ভালো ভাবে নিতেন না। সারারাত কথা চলত তঁাদের।
দিনটি ছিল ৮ই ডিসেম্বর। কাকু শুধু বার বার একটি প্রশ্ন করছে কাকিমা কে? আমি কে? কি মূল্য দিয়েছো তুমি আমাকে? কাকু উচ্চস্বরে চিৎকার দিয়ে বলছে সে আমার বাড়িতে ঢুকতে পারবে না। আমি চাই না তুমি তঁার সাথে যোগাযোগ রাখ। কে ছিল সেই ব্যক্তি আমাদের পরিবারের কেউ সে দিন বুঝতে পারে নি।
কাকুকে যেহেতু বাগানে থাকত তাই কাকুর যাবতীয় কাজ করার মানুষের অভাব হতো না। সবাই কাকুকে খুব মান্য করত। ইদানিং আমাদের বাড়ির কেউ যদি কাকিমাকে ফোন দেয় উনি ভালো ভাবে কথা বলেন না। গত সোমবারে বাবার কাছে ফোন করে বলেছে উনি কিছুদিনের জন্য তঁার বাবার কাছে গিয়ে গাজীপুরে থাকতে চায়।এরপরে আমি যতদূর জানি কাকিমা আর কাকুর কখনো দেখা হয় নাই।
ঢাকা শহরের পুরাতন ঢাকায় আমরা থাকতাম। আমাদের বাড়িটি দেখতে খুব সুন্দর না হলেও বাড়ির মালিক ছিল খুব ভালো মানুষ ছিল।প্রতিদিন বাবা ও জেঠুর সঙ্গে এসে গষ্প করতেন।কাকিমা থাকতেন মোহাম্মদপুরে কিন্তু উনি খুব কম আসতেন আমাদের বাসায়। কাকু যখন সিলেটে থেকে ঢাকায় আসত তখন কাকিমা মনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসতেন আমাদের বাড়িতে। মুখ দেখে বুঝতে পারত সবাই উনি শান্তি তে নেই। চোখে মুখে হতাশার ছাপ থাকত।
কাকু কাকিমাকে নিয়ে প্রত্যেক বছরের শুরুতে দেশের ভিতরে কোন না কোন জায়গায় বেড়াতে যেত।আমি বাবাকে বলতাম বাবা কাকু এত টাকা কিভাবে আয় করে? বাবার কাছে থেকে কোন উত্তর পেতাম না। মনটা বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করত বাবা মাকে নিয়ে। কিন্তু বাবার সামান্য আয়ের কথা চিন্তা করে চুপ থাকতাম।স্বপ্ন গুলো স্বপই থাকত। কাকু আমাদের সেই বার চট্টগ্রাম বেড়াতে যেতে বলেছিল কিন্তু কাকিমার কারনে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে রাজী হয় নাই।
আমার বোন রুম্পা ও টুম্পার বয়সে তারা দু বছরের ছোট বড়। রুম্পা দ্বিতীয় শ্রেনীতে ও টুম্পা প্রথম শ্রেনীতে। দেখতে একদম পুতুল। কাকু ১ সপ্তাহ তাদের না দেখে থাকতে পারত না। চলে আসত সিলেট থেকে ঢাকায়।
কাকিমার বাবার নাম ছিল রনবিজয় চক্রবওী। মাঝে মাঝে বাবা উনার মোবাইলে ফোন দিতেন আমার বোনদের সাথে কথা বলার জন্য । তঁারা বাবাকে জেঠুমনি ডাকত। বাবা খুব খুশী থাকত তাদের সাথে কথা বলার পর। সামনের দিন গুলির কথা ভাবতেই পারিনা আমরা।কিভাবে চলবে আমাদের জীবন। শান্তি তো আর কোনদিন আসবে না আমাদের সংসারে।
১ লা মে কাকু বাবাকে ফোন করে বলল দাদা রুম্পার মা গাজীপুরে নেই, আমার দুই মেয়ে কে নিয়ে তঁার এক মাসির বাড়ি নারায়ণগঞ্জ এসেছে। আমি বাগানের নিবারন দার কাছে থেকে জানতে পেরেছি। কাকুর গলার স্বর দেখে বাবা বার বার বলছিল সূর্য এতটা উওেজিত কেন ভাই ? আমি দেখছি তোমার সব বিষয়।বোনদের সাথে কথা বলতে চাইলেও কাকিমা ফোন দেয় না কাকুকে। মাসষিক কষ্ট দিন দিন বাড়তে থাকে কাকুর।
বুকের ভিতরে রক্ত ক্ষরন চলছিল কিন্তু কাউকে সেটা বুঝতে দেয়নি আমার ছোট কাকু।একদিন রাত ২ টায় ফোন করে বাবাকে সব জানিয়ে ছিল।আমি সবটা জানতে না পারলেও আন্দাজ করেছিলাম কাকিমা সাগর নামের ঐ ছেলেটির সাথে কোন অজানা সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে। যেখান থেকে বের হয়ে আসার পথ অনেক জটিল।
বাবাও জেঠু নিজে গিয়েছিল নারায়ণগঞ্জ। কিন্তু কাকিমা ফেরে নাই। বোনদের আনতে চেয়েছিল আমাদে র বাড়িতে কিন্তু কাকিমা ছোট করে বলেছিল না। সম্ভব নয় দাদা। আমি জানাব আপনাদের আমি কবে আসছি ঢাকাতে।
দিনের পর দিন মাসের পর মাস কাকু অপেক্ষা করত তঁার ছোট্ট দুই মেয়ের জন্য। তারা ফিরে আসবে। কিন্তু কাকিমা আসে না।কাকু নারায়ণগঞ্জ যেতে চাইলে কাকিমা বলে যদি কাকু যায় তাহলে সে পরবর্তী তে কাউকে কিছু না জানিয়ে অজানা জায়গায় চলে যাবে । কোনদিন তাঁকে কেউ পাবে না। মা বাবাকে শুধু একটা কথা ই বলে এইভাবে প্রতিশোধ নিল ছেলেটার প্রতি।টেলিফোনে কথা বলতে বারন করায় এত বড় প্রতিশোধ।সাগর তঁার কে? বাবা ও আমার জেঠুমনি কোন উত্তর না দিয়ে শুধু কঁাদত।
সরস্বতী পুজার দিন সারাদিন আমাদের সাথে খুব আনন্দে ছিল কাকু।রাতে সিলেট যাবার উদেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।সারাদিন চেষ্টা করেছিল মেয়েদের সাথে কথা বলার।কিন্তু বলতে পারে নি আমার কাকু। এটাই ছিল আমাদের শেষ দেখা। রাতে ট্রেনে উঠার আগেই নিজেকে চলন্ত ট্রেনের নিচে সপে দেয়। ছিটকে যায় তঁার দেহ।খবরে কাগজে উঠে খবর।কেউ চিনতে পারেনি আমার বন্ধু আমার প্রানের চেয়ে প্রিয় আমার কাকুকে।দুই দিন পরে বাবা শনাক্ত করে লাশ দেখে আমার সূর্য কাকুকে। আমার মাফলার তঁার গলায় জড়ানো ছিল। বাবা বলত কাকুকে তোর এই মাফলারটি কেন এত পছন্দ। কাকু বলত এটা আমার বাবার মাফলার।
কি কষ্ট!! আমি জানি না পরবর্তী দিনগুলি আমরা কিভাবে থাকব। শুধুই প্রশ্ন আমার কাকুর মতো স্বামী কেন পেল না ভালো বাসা? সন্তানকে পেল না কাছে। বাবা কি পারবে, আমার ছোট দুই বোনকে বাবার ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করতে। কাকুর ছিন্ন দেহ জোড়া লাগানোর চেষ্টা করে আর চিৎকার দিয়ে কঁাদে আমাদের পুরো বাড়ি। দাহ করার আগে কাকিমা আসে বোনদের নিয়ে। কিন্তু………………
সমাপ্ত।
“আমি গল্প লিখি সমাজের জন্য”
joyosree Mohan Talukder
মন্তব্য করুন