মাহবুবুল আলম
দীর্ঘদিন থেকে বিদেশে বসে অনলাইন প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে কিছু দেশবিরোধী কুচক্রী ও ষড়যন্ত্রকারীরা একটি মহলের পেইড এজেন্ট হিসেবে সরকার ও দেশের উন্নয়ন বিরোধী অপপ্রচার মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়ে ইউটিউবে মিথ্যা, আজগুবি ও তথ্যপ্রমাণহীন ভিডিও ও কন্টেন্ট আপলোড করে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে আদা-জল খেয়ে নেমেছে। তারা জানে বিদেশে বসে যতই অপকর্ম করুক না কেন সরকার এদের টিকিটিও ছূঁতে পারবে না। তাই তারা এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো এদের ফেন এবং ফলোয়ারের সিংহভাগই জামাত-বিএনপি ওসরকার বিরোধী লোক। এরা তাদের মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের ভিডিও কন্টেন্ট নিজের ওয়ালে শেয়ার করে ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচার উসকে দিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। কেউ বুঝে বা না বুঝে এসব লাইক কমেন্ট করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
তা দেখে এসব ষড়যন্ত্রকারীরা দিগুণ উৎসাহে সরকার ও দেশবিরোধী ভিডিও আপলোডের মাধ্যমে ভিউয়ার বাড়িয়ে ফায়দা লুটছে। তাই এরা যা মনে আসছে তা-ই করে ও বলে বেড়াচ্ছে। এদের মূল এজেন্ডা হচ্ছে, দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করা, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা, যুদ্ধাপরাধী অপশক্তি এবং জঙ্গিবাদের পক্ষে জনসর্থন আদায় করা এবং এদের কেউ কেউ আইএস এবং হিযবুত তাহরীরের সঙ্গেও সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে।
এসব দেশবিরোধী অপপ্রচারকারীদের মধ্যে, ইলিয়াস হোসেন, কনক সারোয়ার, আছেন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক পিএস শামসুল আলম, আছেন ডেভিড বার্গম্যান, যিনি যুদ্ধাপরাধীদের আইনজীবি এবং ড. কামাল হোসেনের জামাতা মীরজাহান, তাজ হাশমী, তাসলিম খলিল, বিএনপি নেতা সাইফুল মোহাম্মদ বশিরুল হক সিনহা, টিটো রহমান, নাজমুস সাকিব, আসিফ আহমেদ ও আমান আবদুহু প্রমুখ। আর ইলিয়াস হোসন ও কনক সারোয়ার তো সরাসরি ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল।
আমি এই কলামে আজ শুধুমাত্র পিনাকী ভট্টাচার্য বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করবো। অন্য কোনো লেখায় অন্যান্যদের বিষয়ে লেখার চেষ্টা করবো। প্রিয় পাঠক আসুন এই পর্যায়ে পিনাকী ভট্টাচার্য তার সম্মন্ধে কিছুটা জেনে নেয়া যাক। ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়া এই ব্যক্তি একসময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যান। যাওয়ার আগে তিনি নিজেই গুম হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে বিভিন্ন প্রপাগান্ডা ছড়ান। পিনাকী ভট্টাচার্য ধর্মীয় উসকানি ছড়াতে ইউটিউবে তার নিজ চ্যানেলে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন বিধান নিয়ে কট্টর সমালোচনা করেন। গো-হত্যার পক্ষে অবস্থান নিয়ে সনাতন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন তিনি। পিনাকী ভট্টাচার্য একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের বিপক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমালোচনার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় নিয়ে ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপ করেন। পিনাকী ভট্টাচার্য মঙ্গল শোভাযাত্রা ও বাংলা নববর্ষ পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন বর্জনেরও ডাক দিয়েছেন।
বগুড়া জিলা স্কুলের প্রয়াত শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্যামল ভট্টাচার্যের বড় ছেলে ডা. পিনাকী ভট্টাচার্য। মায়ের নাম সুপ্রীতি ভট্টাচার্য। তার ভাই অপূর্ব ভট্টাচার্য ঢাকায় থাকেন এবং বোন বুলবুল ভট্টাচার্য থাকেন বগুড়ায়। পিনাকী সনাতন ধর্ম, দেশের প্রচলিত রাজনীতি, ধর্মীয় সম্প্র্রীতির বিপক্ষে কথা বলায় বাবা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন।
পিনাকী ২০১৮ সালে পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানেরও কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বন্দুকযুদ্ধকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড’ উল্লেখ করে মাদক কারবারিদের সমর্থন জোগিয়েছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নামে গুজব ছড়িয়ে স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিশু-কিশোরদের উসকানি দিয়ে তাদের জীবন হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিলেন। বিতর্কিত কর্মকান্ডের কারণে ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাকে তলব করে। এরপরই তিনি স্বেচ্ছায় আত্মগোপনে চলে যান। দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি অবস্থায় তিনি গোপনে সীমান্ত পার হয়ে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকক যান এবং সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে ফ্রান্সে পালিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চান। বর্তমানে ফ্রান্সে বসে তিনি ধর্ম, দেশের কৃষ্টি-কালচার, সরকার, সেনাবাহিনী, বঙ্গবন্ধু পরিবারের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছেন। তিনি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীতের মতো বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মত কাজও করে চলেছেন।
অতিসম্প্রতি ফেসবুক বন্ধু মুজিব রহমান ফেসবুকে লেখা তার একটি নিবন্ধে দেশ ও সরকার বিরোধী পিনাকী ভট্টাচার্যের বিষয়ে লিখতে যেয়ে সৌদি রাজপরিবারের চিকিৎসক ডাঃ মরিস বুকাইলি প্রসঙ্গ টেনে বলেন, “ডা. পিনাকী ভট্টাচার্যের সাথে ডা. মরিস বুকাইলির একটা তুলনা চলে। মরিস সৌদী রাজ পরিবারের চিকিৎসক ছিলেন এবং তাদের অনুরোধে ‘বাইবেল, বিজ্ঞান ও কোরআন’ নামে একটি বই লিখেন। যেখানে তিনি দেখান বাইবেল ভুল, বিজ্ঞান ভুল এবং একমাত্র কোরআনই মহাবিজ্ঞানময় গ্রন্থ। মুসলিমরা এই বইটিকেই ভেবেছিল তাদের মুক্তির পথ। তারা বিজ্ঞানকে ত্যাগ করে আকড়ে ধরে গ্রন্থটিকে। বইটির ব্যাপক কাটতি হয় এবং মুসলিমদের কাছে মরিস হিরো হয়ে উঠেন। বইটি মুসলিমদের বিজ্ঞান বিমূখ করে দেয় এবং তারা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ হয়।
আজ মুসলিদের মধ্যে বিজ্ঞান বিরোধীতার মারাত্মক ভাবাদর্শ দেখা যায় তার পেছনে এই বইটির ভূমিকা রয়েছে।… পিনাকী ভট্টাচার্য মরিসের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি এখন কট্টরপন্থী বাংলাদেশি মুসলিমদের কাছে মরিসের চেয়েও জনপ্রিয়। তাঁর বইয়েরও কাটতি অনেক এবং তার ইউটিউব চ্যানেল বিপুলভাবেই জনপ্রিয়। রাস্তাঘাটে ও ফেসবুকে অনেকেই পিনাকীর বক্তব্যকে উগড়ে দেন। তরুণ মৌলবাদী মুসলিম বিশেষ করে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।
এক বন্ধু বলেছেন দেশের কিছু মাদ্রাসায় নাকি পিনাকীর বক্তব্য বড় পর্দায় দেখানো হয়। অথচ মরিস ও পিনাকি কেউ মুসলিম হননি৷”
তার সকল বক্তব্যই তথ্য-যুক্তিহীন। তিনি দেশের ব্যাংক ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এমন প্রচারণা চালিয়ে কিছুদিন মানুষকে হয়রাণীর মধ্যে রেখেছিলেন। মানুষ তখন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ঘরে রাখলো। তারা আবার কিছুদিন পরে তা ব্যাংকে জমা দিয়ে গেল। বাংলাদেশে খেলাপী ঋণের মারাত্মক সংস্কৃতি রয়েছে। এরপরেও ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত মুনাফা করছে। এর বিরুদ্ধে না বলে তিনি বলা শুরু করছেন, আমানত উঠিয়ে নেয়ার জন্য। তিনিতো বলেছিলেন, মার্চের মধ্যে রিজার্ভ শূন্য হয়ে যাবে। সহসাই বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার মতো দেউলিয়া হয়ে যাবে।সরকার ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরেও ভিক্ষা পাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।
চিহ্নিত এই অপপ্রচার কারীরা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপ্রপচার করে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে তাদের তৎপরতা আরো বেড়ে যায়। করোনা ভাইরাসের সময়েও তারা নানান অপপ্রচারে লিপ্ত ছিল। অথচ এটা ছিল বৈশ্বিক সংকট। সেই সংকট মোকাবিলায় সারা বিশ্ব যখন হিমশিম খেয়েছে; সেখানে বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় একটা জাতীয় ঐক্যমত গঠন করেছে।জনগণ সবাই মিলে এর মোকাবিলা করছে। সরকার তার সব রকম চেষ্টা করছে এর প্রতিরোধে। সেখানে এই দেশ বিরোধীরা করোনা মোকাবিলায় জনগনের পাশে থাকার বদলে জনগনের মধ্যে নানা রকম বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানান মনগড়া মিথ্যা অপপ্রচার করে করোনা নিয়ে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরী করার নোংরা খেলায় মেতে উঠেছিল। সর্বশেষ বিদ্যানন্দকে নিয়ে তিনি অভিযোগ এনেছেন অন্যের কাপড়ের অলঙ্কার নিজের বলে চালিয়েছেন, এক গরুকে বারবার দেখিয়েছেন কিংবা এক মজিদ চাচাকে ভিন্নভাবে এনেছেন এবং পাহাড়ে ভারতের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করার জন্য জমি কিনেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, পিনাকী ভট্টাচার্য হিন্দু নাম ব্যবহার করে হিযবুত তাহরীর, আল-কায়েদা ও আইএসআইএসের মতো উগ্রবাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের অপচেষ্টা করছেন, যাতে হিন্দু নাম ব্যবহার করলে মানুষ তার এসব অপপ্রচার বিশ্বাস করে। এটি উগ্রবাদীদের একটি অপকৌশল মাত্র। তিনি যেসব বক্তব্য প্রচার করেন, বাস্তব জীবনে এর কোনো প্রতিফলন নেই।
ইউমেন চ্যাপ্টার নামে একটি ওয়েবসাইটে লেখক শেখ তাসলিমা মুন লিখেছেন, ” পিনাকী বুঝতে পেরেছেন এ অঞ্চলে মৌলবাদই একটি উদীয়মান শক্তি। যে সরকারই আসুক এদের পায়ে তেল মর্দন ছাড়া কারও পক্ষে ক্ষমতা পোক্ত করা সম্ভব নয়। তারাই মূল শক্তি। তাই পিনাকী অ্যানালাইসিস করে দেখেছেন, তার ক্ষমতা ও শক্তি বাংলাদেশের যে কোনো সরকারের চেয়ে শক্তিশালী। সরকার যাবে, সরকার বদলাবে, কিন্তু এদের ক্ষমতা কেবল বাড়তেই থাকবে এবং এটাই তার সব সাহসের মূল উৎস। পিনাকী আমাদের কাছে অসৎ, অসাধু এবং একটি ভয়ংকর সন্ত্রাসের নাম। তিনি এমন একটি গ্রুপকে উপজীব্য করে বলয় গড়ে তুলেছেন, যা দেশের মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। আর পিনাকী, আপনাকে বলব, একমাত্র পিচাশেরই বিবেক থাকে না। মানুষের বিবেক থাকে। আমি জানি আপনি যে কাজ করছেন সেটি আপনার ঠান্ডা মাথার সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। আপনার ভিতর একটি কদাকার উল্লাস কাজ করে এ খেলায়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সব খেলার শেষ আছে। গেম ওভার আছে। আমরাও আপনাদের দেখছি আগ্রহ নিয়ে। মনে রাখবেন, কেউই দিন শেষে বিবেক ও বিচারের ঊর্ধ্বে নয়।”
পরিশেষে বলতে চাই, সরকারের উচিত মিথ্যা অপপ্রচারকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে জাতিকে সচেতন করা। এই সমস্ত অপপ্রচারকারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যে নোংরা খেলায় মেতেছে তা প্রতিরোধে তারা যে যে দেশে বসে দেশবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত কুটনৈতিক চ্যানেলে মাধ্যমে সেসব দেশের সরকারেরর সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে এদের দেশে ফিরিয়ে আনার যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
মন্তব্য করুন