আব্দুল কুদ্দুসঃ-
মুমূর্ষু রোগী, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা, আগুন ও এসিডে পুড়ে দগ্ধ, হৃদরোগ, ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত, প্রসবকালীন রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত মা, অস্ত্রোপচার, কিডনি প্রতিস্থাপন, রক্তে অ্যানিমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, রক্ত বমি, ডেঙ্গু জ্বরসহ নানা কারণে রক্তের প্রয়োজন হয়ে থাকে। সময় মতো রক্তের যোগান না হলে রক্তপ্রত্যাশী রোগী মারা যেতে পারে। এমন সংকটময় মুহূর্তে রক্তদাতারা ছুটে যান রক্ত নিয়ে। রক্তদান করেন স্বেচ্ছায়, বাঁচে মানুষের জীবন।
স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের মধ্যে এমনই একজন হলেন সাঈদুর রহমান চৌধুরী। হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার কালিয়ারভাঙ্গা ইউনিয়নের পুরানগাঁও গ্রামের চিকিৎসক পরিবারের সন্তান সাঈদুর রহমানের রক্তের গ্রুপ ‘বি’ পজেটিভ। তার পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মো. হাফিজুর রহমান চৌধুরী একজন অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক। মা আছিয়া খাতুন বাংলাদেশ রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ। সাঈদুর রহমানের দুই বোনের মধ্যে বড় বোন সাবিহা মাহবুব চৌধুরী ডিপ্লোমা ডেন্টাল টেকনোলজিস্ট। আর ছোট বোন ডা. শাহনাজ রহমান চৌধুরী সিলেট আল-হারামাইন হাসপাতালের গাইনী বিভাগে আইএমও হিসাবে কর্মরত। তার স্ত্রী ডা. ফেরদৌসী আক্তার ব্রাহ্মণবাজার উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সাব এসিস্টেন্ট কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। তিন সন্তানের জনক সাঈদুর রহমান চৌধুরী ভাই বোনের মধ্যে সবার বড়। সাঈদুর রহমান পেশায় একজন চিকিৎসা প্রযুক্তিবিদ।
২০০৪ সাল হতে রক্তদানের সাথে সম্পৃক্ত। কুলাউড়ার দক্ষিণাঞ্চলের লংলা এলাকার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হতদরিদ্র সুফিয়া বেগম কে দিয়েই রক্তদানের প্রথম কাজ তিনি শুরু করেন। আলাপকালে সাঈদুর জানান, রক্ত সঞ্চালনের জন্য ইতিমধ্যে তেরোটি সংগঠন করেছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিরাপদ ব্লাড ট্রান্সমিশনের জন্য সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান হাতে গোনা। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, জেলা সদর হাসপাতাল ছাড়া জেলা পর্যায়ে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান পাওয়া দুষ্কর। এরপরও অনুমোদন ছাড়াই অধিকাংশ ক্লিনিকে ব্লাড ট্রান্সমিশন হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কেউ
নিরাপদ রক্ত সঞ্চালনের কাজ করছে না। ব্লাড ট্রান্সমিশনের প্রথম শর্তই হচ্ছে রোগী এবং ডোনারের রক্তের গ্রুপ এক ও অভিন্ন কি-না, দুজনের রক্ত এডজাস্ট, ডোনারের শরীরে হেপাটাইটিস বি ও সি, এইডস, সিফিলিস এবং ম্যালেরিয়া রোগ আছে কি-না তা পরীক্ষা করা। কিন্তু হাতে গোনা দু’একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া কেউই এই নীতি মানছে না। তিনি সরকারি প্রশিক্ষণ নিয়ে বিবেকের তাড়নায় এই কাজে নামেন। তাছাড়া এখন পর্যন্ত ৫২ বার রক্তদান করেছেন বলেও এ প্রতিবেদককে জানান।
সাঈদুর শুধু নিজে রক্ত দেন না, অন্যকেও এ কাজে উৎসাহ দেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে বিনামূল্যে ব্লাড গ্রুপিং ক্যাম্প করেছেন। তরুণদের যুক্ত করছেন সংগঠনে। তারাও রক্তের দরকার হলে এগিয়ে আসে। তার এ কাজের স্বীকৃতি মিলেছে সংগঠন থেকেও। পেয়েছেন সেরা রক্তদাতার সম্মাননা। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, রক্তদান কর্মসূচি ও সামাজিক কাজ করে অসহায় মানুষের উপকার করার চেষ্টা করবো। রক্তদান করলে নিজের শরীরের দূষিত রক্ত বের হয়ে যায়, রক্তের কণিকা বাড়ে। রক্তদান করলে অসহায় মানুষ উপকৃত হয়।
বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, রক্তদানে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যার্টাকের ঝুঁকি কমে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে ও নিয়মিত সুস্থ থাকা যায়, জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি, শরীরে রক্ত প্রবাহিত মারাত্মক রোগ যেমন- হেপাটাইটিস-বি, এইডস, সিফিলিয়া, জন্ডিস ইত্যাদির জীবাণু আছে কি-না নিশ্চিত হওয়া যায়।
সাঈদুর আরও বলেন, নিজে ৫২ বার রক্ত দান করেছি, ইনশাআল্লাহ যতদিন বাঁচবো, রক্ত দান করে যাবো। কোনো রোগীর রক্ত প্রয়োজন হলে সঙ্গে সঙ্গে স্বেচ্ছায় রক্তের ব্যবস্থা করে থাকি। কেউ রক্ত দান করতে চাইলে অথবা কারো ডোনার প্রয়োজন হলে দুজনেরই রক্তের গ্রুপ, নাম ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর নোটবুকে লিখে রাখি। পরে কারো রক্তের প্রয়োজন হলে ওই তালিকা অনুযায়ী আগ্রহী রক্তদাতাদের সহযোগীতায় স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহ দেই। এতে করে ওই রোগীদের জীবন বাঁচে। আমাদের সমাজে বেশির ভাগ মানুষই রক্ত দিয়ে ভয় পায়। এই ভয় থেকেই নিজের আত্মীয়-স্বজনকে রক্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকেন। তিনি আরো বলেন, রক্তদান ও সংগ্রহ করে মানুষের জীবন বাঁচানোই আমার তৃপ্তি। যতোদিন বাঁচবো ততোদিন রক্তদান করে মানুষের উপকার করে যাবো।
কুলাউড়ার গাজীপুর চা বাগানের রিনা ভক্তা নামে এক চা শ্রমিককে জরুরী ভিত্তিতে রক্ত দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যখন তিনি (রিনা ভক্তা) আমার সাথে যোগাযোগ করেন তখন তার রক্তের হিমোগ্লোবিন লেবেল ছিল মাত্র ২.৫৬%। অর্থাৎ এমন পর্যায়ে যে, এই মুহুর্তে তাকে রক্ত না দিলে তিনি মারা যাবেন। জীবনের ঝুকি নিয়ে ওইদিন তাকে ব্লাড ট্রান্সমিশন করি। তিনিও প্রাণে বেঁচে যান। বর্তমানে ওই চা শ্রমিক মহিলা এক সন্তানের জননী।সাঈদুর রহমান ১০ হাজারেরও বেশী মানুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণেয় করেছেন। তাছাড়া তিনি ৫ হাজার রক্তদাতা সৃষ্টি করেছেন। যে কারো রক্তের প্রয়োজন হলে রক্তের গ্রুপ দেখে তাকে রক্ত প্রদান করা হয়।
আলাপকালে সাঈদুর আরো জানান, সর্বপ্রথম তিনি ঢাকার কাঁঠাল বাগান থেকে ব্লাড ক্যাম্পিং শুরু করেন। এরপর কুলাউড়া ডাকবাংলো শিরিষতলায়, চট্টগ্রামের যুবলী রোড, টাইগার পাস, দেওয়ান হাঠ, মুরাদনগর, অক্সিজেনের মোড়, কাঠগড় ও হালিশহর, মানিকগঞ্জের ঝিটকা উপজেলা, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, বাহুবল ও বানিয়াচং উপজেলা এবং মৌলভীবাজারের সকল উপজেলায় ক্যাম্পিং করেছেন। ‘নিরাপদ স্বাস্থ্য রক্ষা আন্দোলন’ নামে একটি সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে ক্যাম্পিং করলেও মোট ব্যয়ের শতকরা ৮০ ভাগ শিবু দাস রায় এবং তিনি বহন করে থাকেন। রক্তদানে তার একটি নির্দিষ্ট স্লোগানও রয়েছে। ‘‘একজন মানুষও যেন মারা না যায় রক্তের অভাবে’’ এই স্লোগানে তাকে উৎসাহ দেন পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মো. হাফিজুর রহমান চৌধুরী। আর অনুপ্রেরণা দেয় জাতীয় তরুণ সংঘ কুলাউড়া নামের সামাজিক সংগঠন। পাশাপাশি সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুস সহিদ বাবুল, প্রাক্তণ অধ্যক্ষ মুহিবুর রহমান বুলবুল ও সমাজসেবক শফিক মিয়া আফিয়ান অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তবে তিনি রক্তদানে চা শ্রমিকদের পাশে বেশি সময় দাঁড়ান। ভবিষ্যতে সিলেট বিভাগের সবকটি জেলায় রক্ত যোদ্ধাদের নিয়ে ব্লাড ক্যাম্পিং করার ইচ্ছা পোষণ করেন। তিনি বলেন, ব্লাড ক্যাম্পিং করতে প্রচুর রি-এজেন্টের প্রয়োজন। আর্থিক সহযোগিতা পেলে ক্যাম্পিং কিংবা ব্লাড ডোনার বের করতে সমস্যা হয় না। জন্মের পরপরই শিশু সহ পরিবারের সকলের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করতে সকলের প্রতি আহবান জানান সাঈদুর।
মন্তব্য করুন