শিক্ষাই আলো। আর ২০৪১ সালের উন্নত বাংলাদেশের কান্ডারি তৈরি করার সূতিকাগার হলো বিদ্যালয়। শিশুর মনন ও মগজের পরিপূর্ণ বিকাশের প্রায়োগিক কেন্দ্র হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়। শিক্ষা হলো শিশুর সাংবিধানিক অধিকার। ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বলা আছে-
রাষ্ট্র
(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য;
(খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য;
(গ) আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করিবার জন্য; কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷
বর্তমান সরকার সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ঢেলে সাজিয়েছে। দৃষ্টিনন্দন বহুতল ভবন নির্মাণ, আধুনিক ওয়াশব্লক স্থাপন, গেইটসহ নান্দনিক সীমানা প্রাচীর নির্মাণ, শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, প্লেয়িং এক্সেসরিজ স্থাপন, বর্ণিল সাজে সজ্জিত শ্রেণিকক্ষ। শিশুকে নিয়মিত উপস্থিতির জন্য ১ কোটি ৪০ লাখ শিশুর অভিভাবকের মোবাইলে উপবৃত্তি প্রদান করছে। এছাড়া বছরের শুরুতে স্কুল ড্রেস, জুতা ও ব্যাগের জন্য প্রতিটি শিশুকে ১০০০ টাকা করে প্রদান করছে। স্কুল ফিডিং কার্যক্রমও পাইলটিং পর্যায়ে রয়েছে। তবুও চা বাগানের শিশুদেরকে বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত করা যাচ্ছে না। নিশ্চিত করা যাচ্ছে না শিশুর শতভাগ ভর্তি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ২০২০-২১ সালের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের সূত্রমতে, দেশে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ কোটি ৩৩ লাখ দুটি। এর মধ্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৫ হাজার ৫৬৬টি; বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪ হাজার ৮৪১টি; শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০৫টি; উচ্চ মাদ্রাসা সংযুক্ত ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ৭ হাজার ১৯৮টি; উচ্চবিদ্যালয় সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় ২ হাজার পাঁচটি; কিন্ডারগার্টেন ২৯ হাজার ৮৯৭টি; এনজিও পরিচালিত স্কুল ৪ হাজার ৬১৯টি এবং অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয় ৩ হাজার ১৯৭টি।
এসব প্রতিষ্ঠানে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা (প্রাক-প্রাথমিকসহ) ২ কোটি ১৫ লাখ ৫১ হাজার ৬৯১ জন। এর মধ্যে ছাত্র ১ কোটি ৫ লাখ ৬০ হাজার ও ছাত্রী ১ কোটি ৯ লাখ ৯১ হাজার ৪৫১। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ১ কোটি ২৪ লাখ ২১ হাজার ৭৮২ এবং অন্যান্য প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ৯১ লাখ ২৯ হাজার ৯০৯ জন।
বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুসারে, বিগত দুই দশকে বাংলাদেশে প্রাইমারি ও নারী শিক্ষায় লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে। প্রাইমারি স্কুলে যাওয়ার যোগ্য ছাত্রছাত্রীর ২০০০ সালের ৮০ শতাংশ এনরোলমেন্ট ২০১৫ সালে বেড়ে ৯৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যা সত্যিই সরকারের অভূতপূর্ব অর্জন। তবুও প্রাথমিক শিক্ষায় এখনো কয়েকটা ক্ষেত্রে আরো কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমনঃ চা বাগানের বিদ্যালয় গমনোপযোগী শতভাগ শিশুকে ভর্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। শতভাগ শিশুর ভর্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ১. অভিভাবক (চা শ্রমিক) অসচেতনতা ২. জন্মনিবন্ধন করার ক্ষেত্রে অর্থ ও সেবার জটিলতা ৩. দারিদ্র্যতা ৪. শিক্ষা উপকরণের সংকট ৫. স্কুলের দূরত্ব ৬. পর্যাপ্ত স্কুলের অভাব ৭. পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব ৮. চা শ্রমিকদের নিজের ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন না করা ৯. উপবৃত্তি ১০. মিড ডে মিল বা স্কুল ফিডিং।
বর্তমানে চা শিল্পে শ্রমিকের সংখ্যা আনুমানিক ১ লাখ ৩০ হাজার আর মোট জনসংখ্যা ৬ লাখের বেশি৷ শ্রমিকদের মধ্যে ৭৫ ভাগই মহিলা শ্রমিক। ভিন্ন ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতির প্রায় ৯৮টি জাতিগোষ্ঠী চা বাগানে বসবাস করে।
দেশে ১৬৩ টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে ৯২টি, সিলেটে ১৯টি, হবিগঞ্জে ২৩টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১টি, চট্টগ্রামে ২২টি, রাঙ্গামাটিতে ১টি, পঞ্চগড়ে ৭টি, ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি চা বাগান।
চা শ্রমিক শিশুদের একীভূত নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সময়োপযোগী কিছু পদক্ষেপ। প্রতিটি শিশুর জন্মনিবন্ধন করতে অভিভাবকদেরকে উৎসাহিত। সরকারের বিশেষ উদ্যোগে জন্মনিবন্ধন সেবা তাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া। চা বাগানে স্কুল অপ্রতুল হওয়ায় সকল শিশু স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। তাই চা বাগানের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে নিম্মোক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
১. প্রতিটি চা বাগানে এক বা একাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন।
২. চা বাগানের শিক্ষা কেন্দ্রগুলোকে জাতীয়করণ করা।
৩. মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা। চা শ্রমিকদের নিজ মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা।
৪. সরকারিভাবে প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
৫. বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী/ আদিবাসী হিসেবে কোটার সুবিধা দেয়া।
৬. জন্মনিবন্ধন সহজীকরণ।
৭. চা বাগানের স্কুলগুলো মিড ডে মিল বা স্কুল ফিডিংয়ের ব্যবস্থা করা।
৮. বিশেষ প্রণোদনা হিসেবে সকল শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ।
৯. কর্মরত শিক্ষকগণকে মাতৃস্নেহে পাঠদান করতে হবে। শিশুর সাথে মিশতে হবে।
১০. বিদ্যমান স্কুলগুলোকে বর্ণিল সাজে সজ্জিত করতে হবে।
১১. স্কুলে খেলাধুলা করার সময় দিতে হবে। পর্যাপ্ত ক্রীড়া সামগ্রীর বন্দোবস্ত করা।
১২. বিশেষ উপবৃত্তি প্রদান করা।
১৩. শিক্ষকদেরকে নিয়মিত হোম ভিজিট, উঠান বৈঠক ও মোবাইলে অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ করতে।
১৪. স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয় করে পাঁচ বছর মেয়াদী একটি ‘একশন প্ল্যান’ প্রণয়ন করা ও তা বাস্তবায়নে স্থানীয় গণ্যমান্য লোজজনকে স্কুলের সাথে সম্পৃক্ত করা।
১৫. শিক্ষক নিয়োগ করার সময় চা বাগানের প্রার্থীদেরকে বিশেষ কোটায় নিয়োগ প্রদান করা।
ড. মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষা কমিশনে প্রতি ১৫০০ মানুষের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রতিটি চা বাগানে গড়ে প্রায় ৪,৪৮৭ জনবসতি থাকলেও কোন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। ১৫৮ টি চা বাগানে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ১৪০ টি বেসরকারী শিক্ষা কেন্দ্র থাকলেও সেগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। ড. মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতিটি বাগানে প্রায় ৩টি এবং সকল বাগানে মোট ৪৬৬ টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা। জীর্ণ-শীর্ণ স্কুলঘরে ছেলেমেয়েরা আসা যাওয়া করে বন্ধুর পথ হেঁটে।
দেশে অনেক সাংবিধানিক সুরক্ষা এবং শ্রম আইন রয়েছে, যা মানবাধিকার এবং মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১৫ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটি হলো পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা এবং খাদ্যসহ মানুষের জীবনযাত্রার উপাদান ও সাংস্কৃতিক মান উন্নত করা। নাগরিকদের জন্য পোশাক, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবা। জীবনের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা অর্জন নিশ্চিত করা যেতে পারে।
চা বাগানগুলোতে বাগান কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে এক কক্ষবিশিষ্ট একটি শিখন কেন্দ্র রয়েছে। যেখানে একজন শিক্ষক শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকেন। এই স্কুলগুলোও বেশ ভঙ্গুর। শিশুদের চিত্তকে আকর্ষণ করে না। তাই কিছু শিক্ষার্থী স্কুলে ভর্তি হলেও তারা স্কুলে নিয়মিত আসে না। একটা সময় ঝরে পড়ে। স্কুলের শিক্ষকদেরকে হতে হবে আরো বেশি যত্নশীল। শিশুদের মানবিক আচরণ করতে হবে। কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না। তাছাড়া স্কুল ফিডিং উদ্যোগ নেই বলে তারা টিফিন পিরিয়ডে স্কুল পলায়ন করে। তাই সকল চা বাগানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন অতীব জরুরি। তা না হলে চা বাগানের ৩০% থেকে ৪০% শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। একীভূত প্রাথমিক শিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়বে। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির অদৃশ্য ও দানবীয় অন্ধকার গিলে খাবে চা বাগানের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা।
মোঃ রফিকুল ইসলাম
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
মাধবপুর, হবিগঞ্জ।
০১৭১৬৩৮৩৪৩৮
মন্তব্য করুন