আওয়ামী লীগ যেন ভূঁইফোড় সংগঠের আড়ালে চাপা পড়ে যেতে বসেছে


দ্যা সিলেট পোস্ট প্রকাশের সময় : অক্টোবর ২, ২০২১, ১২:৪৪ পূর্বাহ্ন /
আওয়ামী লীগ যেন ভূঁইফোড় সংগঠের আড়ালে  চাপা পড়ে যেতে বসেছে

নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ উপমহাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ অঞ্চলের গণমানুষের বিভিন্ন দাবি দাওয়া আদায়ের আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে এসেছে এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে এদেশের গণমানুষের দলে পরিনত হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়োগান্তক হত্যাকান্ডের পর যারা ভেবেছিল এদেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি শেষ, তাদের অনুমান মিথ্যা প্রমাণিত করে নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কন্যার
সুযোগ্য নেতৃত্ব অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিনত হয়েছে এবং পর পর তিনটি জাতীয় নির্বাচনে হেট্টিক বিজয়ের মাধ্যমে সরকার গঠনের মাধ্যমে দেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিনত করেছেন।

কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে বলতে দ্বিধা নেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মাধ্যমে দলটি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকলেও ক্ষমতার ভারে দলটি যেনো ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে পরেছে। পুরো দলটিই যেনো সরকারে বিলীন হয়ে গেছে। এই সুযোগে আওয়ামী লীগ নামক বিশাল বটবৃক্ষটি এখন বিভিন্ন আগাছা পরগাছায় ভরে গেছে। এই আগাছা পরগাছাদের দাপটে মূল দল আওয়ামী লীগ যেনো অস্তিত্ব সংকটের মধ্য পড়েছে।

এ বিষয়ে “বড় গাছ থেকে এখনই আগাছা দূর করা দরকার”। এই শিরোনামে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট জনাব আবদুল
গাফ্ফার চৌধুরীর দৈনিক যুগান্তরে সাম্প্রতিক লেখা কলামের অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করছি: “গাছ যখন বুড়ো হয়, তাতে আগাছা জন্মে। এই আগাছা সময়মতো পরিষ্কার করা না হলে তাতে নানা ধরনের কীট বাসা বাঁধে। তারা গাছটাকে খেতে শুরু করে। গাছটি মাথা উঁচু করে তারপরও দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু হঠাৎ একদিন সামান্য ঝড়ে পড়ে যায়।… আমার ভয় হয়, আওয়ামী লীগ নামক প্রাচীন সংগঠনটিরও আজ এই অবস্থা। এত আগাছা জন্মেছে এবং এত কীট গাছটির শেকড় খেতে শুরু করেছে যে, ভয় হয় এই গাছটি না হঠাৎ পড়ে যায়। তাহলে সেটি হবে বাংলাদেশের জন্য এক চরম দুর্ভাগ্য।
…অবশ্য একটি গণতান্ত্রিক দলে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব নয়। সেখানে সবারই অবাধ অধিকার। ভারতের কংগ্রেসে যা ঘটেছে, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগেও তাই ঘটছে। দুটি দলই এখন বৃদ্ধ বনস্পতি। কংগ্রেসের নেতৃত্ব নেহেরু পরিবারের হাতে। তারা অসাম্প্রদায়িকতার কথা বললেও অসংখ্য সাম্প্রদায়িক নেতা ও কর্মী কংগ্রেসে অনুপ্রবেশ করেছে। আজ আর কংগ্রেস আগের সেই দল নেই। আজ আওয়ামী লীগেরও শীর্ষ নেতৃত্ব শেখ হাসিনা অসাম্প্রদায়িক; কিন্তু দলে বানের জলের মতো সাম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ এবং নীতিহীন ও চরিত্রহীন মানুষের ঢল ঢুকে পড়েছে।
এই আওয়ামী লীগে যদি কঠোর হাতে পরগাছা বর্জন শুরু না হয়, তাহলে আমার সন্দেহ হয়, কেবল টাকাওয়ালা মানুষকে নির্বাচনে নমিনেশন দিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হবে কিনা।”

আমি তাঁর কথার সাথে একমত পোষণ করে বলছি বর্তমানে নামে বেনামে বিভিন্ন ভূঁইফোড় সংগঠনের আধিক্য মূলদলের নামটিই চাপা পড়ে যেতে বসেছে। এইসব সংগঠন নামের শেষে লীগ জুড়ে দিয়ে গজিয়ে ওঠেছে। এভাবে দেশে শতাধিক ভূঁইফোড় সংগঠন গড়ে ওঠেছে। শুধু লীগই নয় কোথাও আবার শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়ের নামও ব্যবহার করছে সুযোগসন্ধানীরা। পাড়া, মহল্লা, গ্রামে, গঞ্জে এখন এরকম সংগঠনের অভাব নেই। এদের অনেকেই আবার নিজেদের আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনও দাবি করে।
এই সমস্ত সংগঠনগুলোর কাজ হলো বিভিন্ন মানুষকে এই সংগঠনের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে চাঁদা আদায়, বিভিন্ন দিবসে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে চাঁদাবাজি করা এবং দলের নাম ভাঙ্গিয়ে মন্ত্রী-এমপিদের কাছে গিয়ে তদবির বাণিজ্য করা। এছাড়াও এরা টেন্ডার বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত।

সাম্প্রতিক সময়ে চাকরিজীবী লীগ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন সদ্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত এবং গ্রেপ্তার হেলেনা জাহাঙ্গীর। এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে তাকে আওয়ামী লীগের মহিলা উপ কমিটি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এরপর আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভুঁইফোড় অবৈধ এ সমস্ত লীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেন।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সহযোগী সংগঠনের সংখ্যা ৮টি। আর ভাতৃপ্রতীম সংগঠনের সংখ্যা দুটি। আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত সংগঠন হলো বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, আওয়ামী মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুব মহিলা লীগ, তাঁতী লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, মৎস্যজীবী লীগ। এছাড়াও নীতিগতভাবে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয় শ্রমিক লীগ, ছাত্রলীগ। মহিলা শ্রমিক লীগ ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ আওয়ামী লীগের নীতিগত অনুমোদিত সংগঠন। এর বাইরে আওয়ামী লীগের সহযোগী কিংবা ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন নাই। তারপরও বিভিন্ন নেতার ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা ভূঁইফোড় এসব সংগঠনের নামগুলোর মধ‌্যে রয়েছে আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী রিকশা মালিক শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী নৌকার মাঝি লীগ, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, জাতীয় শিশু কিশোর লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী তৃণমূল লীগ, বাংলা আওয়ামী সোনার বাংলা লীগ, আওয়ামী হকার্স লীগ, আওয়ামী বাস্তুহারা কল্যাণ সমিতি, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ, আওয়ামী শিশু লীগ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, মোটর চালক লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী পর্যটন লীগ, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী অনলাইন লীগ, বিশ্ব আওয়ামী অনলাইন লীগ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, জননেত্রী পরিষদ, দেশরত্ন পরিষদ, নৌকার সমর্থক গোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী যুব হকার্স লীগ, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, বঙ্গমাতা পরিষদ, আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, আমরা মুজিব হবো, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, আওয়ামী রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী পর্যটন লীগ, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা পরিষদ, চেতনায় মুজিব, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ২১ আগস্টের ঘাতক নির্মূল কমিটি, সজীব ওয়াজেদ জয় পরিষদ, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্মচারী লীগ, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, ঘাট শ্রমিক লীগ, আমরা নৌকা প্রজন্ম, নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল ছাত্রলীগ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী শিশু-যুব সাংস্কৃতিক জোট, বঙ্গবন্ধু ছাত্র পরিষদ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী চাকরিজীবী লীগ।

এসব সংগঠনের কর্মসূচিতে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা প্রধান অতিথি হয়ে যেতেন। ফলে, সংগঠনগুলোর সংবাদ গণমাধ্যমে আসত। মূলত, গণমাধ্যমে আসার কারণে নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের সভাপতি বা সেক্রেটারি সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা নিতেন এবং প্রভাব দেখাতেন।

সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে সরকারি দলটি বারবারই বলে এসেছে, তাদের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাড়া বাকি কোনো সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। এর মধ্যে ‘ওলামা লীগ’ নামে একটি ধর্মীয় সংগঠনের কর্মকাণ্ডে সরকারকে বিব্রতও হতে হয়েছে কয়েকবার। তবে এ সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার কথা বলেছে দলটি বারবার; যদিও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে সংগঠনটির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এ ধরনের সংগঠনের জন্ম নেওয়াও থেমে থাকেনি।

বিভিন্ন পত্রিকা ও যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনা শুরু হলে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতারা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে গজিয়ে ওঠা, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আরও বেশ কিছু সংগঠন হয়েছে। গত প্রায় এক যুগে গড়ে ওঠা এমন ৭৩টি সংগঠনের নাম পেয়েছে দলটি। আওয়ামী লীগই বলছে, এর বাইরে আরও অনেক সংগঠন আছে, যেগুলোর কথা তাদের জানা নেই। সুযোগসন্ধানী এসব সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। এছাড়াও আছে এমন আরো নামসর্বস্ব সংগঠন। এসব সংগঠন গড়ে ওঠার পেছনে অনেক ক্ষেত্রে দলের অনেক নেতাদেরও হাত থাকে। এসব সংগঠনের আয়োজনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও যান তারা। বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে সমালোচনা হলেও কার্যত সবকিছু থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাথে আলাপে নামসর্বস্ব এসব সংগঠনের কারণে আওয়ামী লীগ বিব্রত বলে জানিয়েছেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, লীগ নাম ব্যবহার করে যারা এসব করে বেড়াচ্ছে তারা প্রতারক। তিনি আরো বলেন, নিজের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করার জন্য বা মতলববাজ অভিপ্রায় নিয়ে কেউ যদি কোন চেষ্টা করে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই আমরা সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। আবদুর রহমান আরও বলেন, এদের সঙ্গে কোন ধরনের কোন সম্পর্ক না রাখার আহ্বান আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে জানিয়েছি।

এই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে এ ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বলেই শেষ করতে চাই-এখন আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে ৭৫’এর আওয়ামী লীগের অনেক মিল পাওয়া যায়। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু যেমন একা হয়ে পরেছিলেন আজকে আওয়ামী লীগের দিকে তাকালে তা ই মনে হয়। মনে হয় শেখ হাসিনা এখন একা। আওয়ামী লীগে এখন কাক আর কাকে ভরা। ২০০৯ এবং ২০১৪ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের এমন অসহায় অবস্থা চোখে পড়েনি।

পরগাছায় পরগাছায় ভরা দেশের প্রাচীনতম দলটিকে যেনো চেনাই যায় না। আমরা যারা আওয়ামী লীগের শুভানুধ্যায়ী তারা চাইবো যত দ্রুত সম্ভব শুদ্ধিঅভিযানের মাধ্যমে এসব আগাছা পরগাছাদের দল থেকে বিতারিত করতে হবে, না হলে এরা অচিরেই উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সব অর্জন ও সুনাম ধূলায় মিশিয়ে দিতে পারে।

লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামলেখক ও গবেষক