নূরুজ্জামান ফারুকী হবিগঞ্জ প্রতিনিধি : সেতুর কারণে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালতে যাতায়াতের সমস্যার কথা প্রায়ই শােনা যায়। কিন্তু এমন কথা হয়তাে শােনা দুষ্কর যে সেতুর কারণে গ্রামের তরুণ-তরুণীদের ভালাে বিয়ের সম্বন্ধ হয় না। এমন ঘটনাও ঘটছে নবীগঞ্জে। শুধুমাত্র একটি সেতুর জন্য দুর্ভোগের শিকার কয়েকটি গ্রামের মানুষ। ভালো পরিবার বা ভালাে জায়গায় আত্মীয়তা করা হয় না তাদের। অনেককেই বিয়ে-সাদি দেওয়ার জন্য বাসা ভাড়া নিয়ে শহরে যেতে হয়। এমন আক্ষেপ হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ উপজেলার কালিয়ারভাঙ্গা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের। তবে সেতুটি নির্মাণে বারবারই চেষ্টা করেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
কালিয়ারভাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান ইমদাদুল হক চৌধুরী জানান, তারা বারবারই রেজুলেশন করে সরকারের কাছে ব্রিজটির জন্য লিখেছেন। একবার এটি মঞ্জুরও হয়েছিল । কিন্তু পরবর্তীতে কেন যেন আটকে গেলো তা তার জানা নেই। তিনি বলেন, আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আসলে ব্রিজটি করার কোনাে সুযােগ নেই। সরকার যদি সহায়তা না করে তাহলে তা সম্ভব নয়। আমরা বারবারই চেষ্টা করছি। লহরজপুর গ্রামের নুরুল আমিন বলেন, আসলে যাতায়াতের কারণে আমরা যেমন লেখাপড়া করতে পারিনি, এখন আমাদের প্রজন্মও লেখাপড়াসহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে পড়ছে। পাশাপাশি একজন অসুস্থ হলে রােগী নিয়েও যাওয়া সম্ভব হয় না ।
বাঁশের সাঁকো দিয়ে পারাপার বেশ কষ্টকর হয়ে পড়ে। মাে. এখলাছ মিয়া চৌধুরী জানান, স্বাধীনতার পর থেকে তাদের এ গ্রামে কোনাে উন্নয়ন হয়নি। একটু বৃষ্টি হলেই সাঁকো দিয়ে নদী পারাপার হতে পারি না। বয়স্ক বা শিশু হলেতাে আর কথাই নেই। অনেকেই নদীতে পড়ে যান। তিনি বলেন, আমাদের সবচেয়ে লজ্জার বিষয় হলাে এ ব্রিজটির কারণে ভালাে কোনাে জায়গার মানুষ এ গ্রামে আত্মীয়তা করতে চায় না। শুধু বংশ দিয়ে হয় না। এ যুগে এসেও বাড়িতে একটি গাড়ি যায় না তা কি হতে পারে?
ভালাে সম্বন্ধের আলাপ এলেও তা আর টেকে না । মােঃ আব্দুল জাহির আক্ষেপ করে বলেন, আমরা ভালাে একটি জায়গায় আত্মীয়তা করতে পারি না। বিয়ে দিতেও পারি না, করাতেও পারি না। উচ্চবিত্ত মানুষ কেউ এ গ্রামে আত্মীয়তা করতে চায় না। ভালাে জায়গায় সম্বন্ধ করতে হলে শহরে বাড়িভাড়া নিয়ে যেতে হয়। তিনি বলেন, জন্মের পর থেকে অন্তত ৫০ বছর ধরেই আমি বাঁশের সাঁকো আর নৌকায় শাখা বরাখ নদী পারাপার হচ্ছি। তিনি দ্রুত ব্রিজটি নির্মাণের দাবি জানান। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, কুশিয়ারা নদীর একটি শাখা বরাখ নদী। এটি বাহুবল, হবিগঞ্জ সদর, নবীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলার হাওর দিয়ে বয়ে গেছে। এ নদীটি যেমন হাওরবাসীর সুখের সঙ্গী তেমনি এ নদীর কারণে দুঃখেরও অন্ত নেই।
এ নদীর বেশিরভাগ অংশই পড়েছে নবীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলায়। যদিও বানিয়াচংবাসীর যাতায়াতে এ নদীর তেমন কোনাে প্রভাব পড়েনি। কিন্তু নবীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামকে নানাভাবে ঘিরে রেখেছে এ নদী। একইভাবে উপজেলার কালিয়ারভাঙ্গা ইউনিয়নবাসীরও সুখ-দুঃখেরও সঙ্গী হয়ে আছে এ নদীটি। নদীর পূর্বপাড় দিয়ে মাত্র কোয়ার্টার কিলােমিটার দূরত্বে রয়েছে হবিগঞ্জ-নবীগঞ্জ সড়ক। জেলা সদর থেকে যার দূরত্ব মাত্র ১০ কিলােমিটার। আর পশ্চিমে রয়েছে। লহরজপুর, খলিলপুর, সৈয়দাবাদসহ অন্তত ১০টি গ্রাম ।
গ্রামগুলাের বাসিন্দাদের শাখা বা নদী পেরিয়েই জেলা ও উপজেলা সদরে যাতায়াত করতে হয়। শিক্ষার্থীদেরকেও স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় যেতে হয় । তাই যাতায়াতের জন্য এ এলাকার বাসিন্দারা নদীর ওপর বাঁশ-কাঠ দিয়ে নির্মাণ করেছেন একটি সাঁকো। স।কোর দৈর্ঘ্য ছােট করতে এরইমধ্যে নদীর অর্ধেক অংশ ভরাটও করেছেন তারা। রােগী নিয়েও এ সাঁকো দিয়েই পারাপার হতে হয়। এতে অনেক সময়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেকেই পা ফসকে নদীতে পড়েন। এছাড়া তাদেরকে হাওরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে শ্রীমতপুর গ্রামে নির্মিত পাকা সেতু দিয়ে পারাপার হতে হয় । এদিকে গ্রামের পাশেই রয়েছে জেলার বৃহৎ হাওর ঘুঙ্গিয়াজুরী।
নদীতে সেতু না থাকায় এই হাওরে উৎপাদিত ধান নৌকা দিয়ে বহন করতে হয়। এতে সময়, শ্রমিকের মজুরি ও দুর্ভোগ বাড়ছে। তাই জনগণের দুঃখ দুর্দশা লাঘবে সেখানে একটি পাকা সেতু নির্মাণ জরুরি বলে মনে করেন স্থানীয়রা। নবীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী সাব্বীর আহমেদ বলেন, নবীগঞ্জে আপাতত যে ক’টি ব্রিজ অনুমোদন হয়েছে। সেখানে এটি নেই। তবে প্রায় সবগুলাে ব্রিজই ডিপিপিতে দেওয়া আছে। এগুলাে অনুমােদনের অপেক্ষায় আছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহি উদ্দিন জানান, সবগুলাে ব্রিজের চাহিদার তালিকা এরইমধ্যে পাঠানাে হয়েছে। আশা করা যায় পর্যায়ক্রমে হয়ে যাবে।
মন্তব্য করুন