কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি:
প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য্যরে অপার লীলাভূমি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার পর্যটনকেন্দ্রগুলো পবিত্র ঈদুল ফিতরের টানা ছুটিতে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়ে মুখরিত হয়ে উঠে। চা বাগান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, হামহাম জলপ্রপাত, মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি, ডবলছড়া খাসিয়া পুঞ্জিসহ বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোতে যেন পা ফেলার ঠাই নেই।
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের টিকিট কাউন্টার থেকে জানা যায়, ঈদের দিন মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত টানা তিন দিনে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ টাকা। বৃহস্পতিবার (৫ মে) দুপুরে মাধবপুর লেক ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে দেখা মিলে দুর-দুরান্ত থেকে আগত পর্যটনপ্রেমী ভ্রমণ পিয়াসুদের। এদের মধ্যে স্বপরিবারে ঘুরতে আসা পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। ঈদের দিন মঙ্গলবারের চেয়ে বুধবার লোকজনের উপস্থিতি ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক বেশি। বৃষ্টি উপেক্ষা করেও পর্যটকরা ছুটে এসেছেন জীব বৈচিত্র্যের অপরূপ সমাহার ঘুরে দেখতে। কমলগঞ্জের মাধবপুর চা বাগান ও পদ্মছড়া নয়নাভিরাম মনোরম দৃশ্য পাহাড়ি টিলার উপর সবুজ চা বাগানের সমারোহ, জাতীয় ফুল দুর্লভ বেগুনী শাপলার আধিপত্য, ঝলমল স্বচ্ছ পানি, ছায়া নিবিড় পরিবেশ, শাপলা শালুকের উপস্থিতি আনন্দের বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে। লেইকে সকল শ্রেণি পেশার মানুষের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।
এছাড়া ডবলছড়া খাসিয়া পুঞ্জি, শমসেরনগর বাগীছড়া লেক, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধসহ কমলগঞ্জের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রগুলোতেও পর্যটকদের উপস্থিতি ছিল দেখার মতো। তবে ঝর্ণাধারা হামহাম জলপ্রপাতে পর্যটকদের ভিড় কিছুটা কম ছিল। ভিড় কম থাকার কারণ হিসেবে জানা যায়, পানি কম তাছাড়া, হামহাম জলপ্রপাতে ভ্রমণ করতে পুরো একদিনের প্রয়োজন। আর ৭/৮ কিলোমিটার পথ হেঁটে যেতে হয়। কিন্তু ঈদে বিভিন্ন ইভেন্টে ভ্রমণপ্রেমী পর্যটকরা আসছেন হামহাম জলপ্রপাত দেখতে। তাদের মধ্যে তরুণ-তরুণীর সংখ্যাই বেশী।
ঈদের ছুটিতে লাউয়াছড়ায় জাতীয় উদ্যানে ঘুরতে আসা নরসিংদীর স্কুল শিক্ষক মো: নাসিম মিয়া, কুমিল্লার ব্যবসায়ী আবির আহমেদ, ঢাকার ব্যবসায়ী কামাল আহমেদ, সিলেট থেকে চাকুরীজীবি সালাউদ্দিন আহমেদ, হবিগঞ্জ থেকে কলেজ ছাত্রী ফরিদা বেগম, কলেজ ছাত্র রিপন আহমেদ, কুলাউড়া থেকে বেলাল মিয়া, গৃহিণী সুমাইয়া আক্তার জানান, কমলগঞ্জের লাউয়াছড়ার বন একটি সমৃদ্ধ বন। প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য্য আর জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর এই বনটি যে কেউ দেখলে মন জুড়িয়ে যাবে।
কমলগঞ্জের লেখক-গবেষক ও উন্নয়ন চিন্তক আহমদ সিরাজ জানান, জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, হামহাম জলপ্রপাত, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্যের বাহক বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ, পদ্ম ছড়া লেক, বণ্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য রাজকান্দি বন, শমসেরনগর বিমানবন্দর, প্রাচীন ঐতিহ্যের বাহক লক্ষীনারায়ন দিঘী, ২০০ বছরের প্রচীন ছয়চিরী দিঘী, শমসেরনগর বাগীছড়া লেক, আলীনগর পদ্মলেক, মাগুরছড়া
পরিত্যক্ত গ্যাসফিল্ড, অপরূপ শোভামন্ডিত উচু নিচু পাহাড়বেস্টিত সারিবদ্ধ চা বাগানসহ বাংলাদেশের বৃহৎ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মণিপুরী সম্প্রদায়ের নিরাপদ আবাসস্থল এ উপজেলায়। এছাড়া প্রকৃতির পূজারী খাসিয়া নৃ- গোষ্ঠীসহ গারো, সাঁওতাল, মুসলিম মণিপুরী, টিপরা ও গারোদের নিরাপদ আবাসস্থলও রয়েছে এই উপজেলায়। লেক আর পাহাড়ের মিতালী, সাথে ঝর্ণা কমলগঞ্জের এসব প্রাকৃতিক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে প্রতিবছর ঈদের টানা ছুটিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসে হাজার হাজার পর্যটক। দীর্ঘ করোনার পর এবার কমলগঞ্জ উপজেলায় পর্যটকদের ঢল নেমেছিল।
লাউয়াছড়া ইকো টুরিস্ট গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. আহাদ মিয়া বলেন, ‘ঈদের ছুটিতে লাউয়াছড়াসহ সব পর্যটনকেন্দ্রে প্রচুর পর্যটকের আগমন হয়। ঈদের দিন বৃষ্টি থাকলেও পর্যটকের সংখ্যা চোখে পড়ার মতো ছিল। কিন্তু ঈদের পরের ৭দিন পর্যন্ত পর্যটক বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।’ কমলগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ইয়ারদৌস হাসান বলেন, পর্যটন পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা সার্বক্ষনিক মাঠে ছিল। কমলগঞ্জের সকল পর্যটক এরিয়া আমাদের থানা পুলিশের একটি টিকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছি। কারণ ঈদ আসলেই পর্যটকের ঢল নামে কমলগঞ্জে তাই নির্বিঘেœ পর্যটকরা ঘুরতে পারে সেইজন্য আমরা তাদের নিরাপত্তার জন্য পর্যবেক্ষন করছি।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের লাউয়াছড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, এ ঈদের অন্যান্য সময়ের তুলনায় পর্যটকের সমাগম অধিক ঘটেছে। তবে ঈদে পর্যটকদের উপস্থিতি সব সময়েই বেশি হয়ে থাকে। মেঘ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেও আগত অত্যধিক পর্যটকের কারণে কিছুটা বিঘœ হওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি আরও বলেন, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ করার জন্য পায়ে হাঁটার তিনটি ট্রেইল পথ রয়েছে। দর্শনার্থীরা এই ট্রেইল ঘুরেই চলে যান। এখানে গাইডরাও রয়েছে, এদের বলে দেওয়া হয়েছে যাতে পর্যটকরা এর বাইরে ও কোন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে যাতে বন ও পরিবেশের ক্ষতি না হয় সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে। পর্যটকদের জন্য নিয়ন্ত্রিত ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পর্যটন পুলিশের পাশাপাশি কমলগঞ্জ থানা পুলিশ, র্যাব ও সিএমসি সদস্যদের নিয়ে পর্যটকদের নিরাপত্তা ও প্রকৃতি ভ্রমণ নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
মন্তব্য করুন