মাহবুবুল আলম
বাংলাদেশের সরকারের সর্বোচ্চ ১০ বার বাজেটপ্রণেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী, সিলেটের কৃতিসন্তান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, পরিচ্ছন্ন ও সুশীল রাজনীতিক, কুটনীতিক, লেখক, ভাষাসৈনিক এবং মুক্তিযোদ্ধা বিরল প্রতিভার অধিকারী আবুল মাল আব্দুল মুহিত আজ ৮৯ ববছর বয়সে ঢাকার বনানীতে নিজের বাসায় রাত ১২:৫৬ টায় নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অনন্তের ওপারে চলে গেলেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাইহে রাজেউন। বাংলাদেশ যে আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠতে যাচ্ছে, তারও কারিগরদের অন্যতম তিনি। তাঁর সময়ে বড় হয়েছে বাজেটের আকার।
এক অনন্য গৌরবোজ্জ্বল জীবনের অধিকারী ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। অই দিন সিলেটের ধোপাদীঘির পাড়ের নিজেদের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। বাবা অ্যাডভোকেট আবুল আহমদ আব্দুল হাফিজ এবং মা সৈয়দ শাহার বানু চৌধুরী। দু’জনই রাজনীতি ও সমাজসেবায় সক্রিয় ছিলেন। আবুল মাল আবদুল মুহিতের দাদা খান বাহাদুর আবদুর রহিম ব্রিটিশ ভারতে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। অসম্ভব রসিক আবুল মাল আবদুল মুহিত বলছিলেন, ‘দাদা পর্যন্ত ব্রিটিশ উপাধি থাকলেও বাবার সময় থেকে তা বন্ধ। কারণ, বাবা তখন স্বদেশি হয়ে গিয়েছিলেন। মা-বাবার ১৪ সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান তিনি। ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তাঁর বোন, যিনি এখনো জীবিত। এই বোনের বয়স এখন ৯১ বছর।
১৯৪৯ সালে সিলেট সরকারি পাইলট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় প্রথম স্থান, ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ (অনার্স) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম এবং ১৯৫৫ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাশ করেন। চাকরিরত অবস্থায় তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নসহ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমপিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি) যোগ দেওয়ার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, কেন্দ্রীয় পাকিস্তান এবং পরে বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭২ সালে তিনি পরিকল্পনা সচিব নিযুক্ত হন আবুল মাল আব্দুল মুহিত। তবে এই দায়িত্ব গ্রহণ না করে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে ওয়াশিংটন দূতাবাসে ইকোনোমিক মিনিস্টারের দায়িত্ব নেন।
১৯৭৪ সালে তিনি এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকে নির্বাহী পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। এখন পর্যন্ত তিনি একমাত্র বাংলাদেশি যিনি এ পদে আসীন হয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিব পদে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ সালে চাকরির ২৫ বছর পূর্তিকালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি স্বেচ্ছায় সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেন।
ওয়াশিংটন দূতাবাসের তিনি প্রথম কূটনীতিবিদ, যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ১৯৭১ -এর জুন মাসে পাকিস্তানের পক্ষ পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য প্রদর্শন করেন। ১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে তিনি অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও ইফাদে কাজ শুরু করেন। ১৯৮২ সালে সামরিক সরকার প্রধান এরশাদের আমন্ত্রণে শর্তসাপেক্ষে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। শর্ত ছিল নির্বাচনের মাধ্যমে দ্রুত দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু এরশাদ সে শর্ত পালন না করায় তিনি মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন।এটিও একটি বিরল দৃষ্টান্ত। ৯৫ হাজার কোটি টাকার বাজেটকে তিনি ৪ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ে টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালন করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
১৯৯১ সাল থেকে তিনি সার্বক্ষণিক দেশে অবস্থান করে একজন নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে ভূমিকা রাখতে শুরু করেন। বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশবাদী সংগঠনে সম্পৃক্ত হয়ে দেশের সুশীল সমাজের একজন অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। ২০০৯ সালে সিলেট-১ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত থাকার সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন মুহিত। এরপর প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেন। এ কারণে তাঁকে ২০১৬ সালে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বেসামরিক সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ দেওয়া হয়। তাঁর লেখা বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় ৪০টির মতো বই রয়েছে। প্রায় ৪৫ হাজার বইয়ের বিরাট সংগ্রহশালা আছে তাঁর।
২০২১ সালের ২৫ জুলাই আবদুল মুহিত করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত মার্চের শুরুতে আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন কিছুদিন। এর মধ্যে সুস্থ হয়ে ১৪ মার্চ সিলেট ঘুরে আসেন। সিলেট সিটি করপোরেশন ১৬ মার্চ তাঁকে ‘গুণী শ্রেষ্ঠ সম্মাননা’ দেয়। তিনি স্বজনদের বলতেন সিলেট আমাকে খুব টানে। আমি আবার সিলেট যাব।’ কিন্তু প্রিয় সিলেটে
তাঁর আর যাওয়া হলো না।
আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় গুলশান আজাদ মসজিদে প্রথম জানাজা, এবং সকাল সাড়ে ১১টায় সংসদ প্লাজায় দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।এরপর দুপুর ১২টায় তার মরদেহ সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য শহীদ মিনারে নেওয়া হবে। এরপর দাফনের জন্য সিলেটে নেয়া হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও আর্ন্তজাতিক অর্থনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশের সম্পৃক্তি ও সমৃদ্ধিতে তিনি বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ছিলেন ইতিহাস-ঐতিহ্য সচেতন আলোকিত গুণীজন, একজন ন্যায়নিষ্ঠ, সজ্জন ও চিৎপ্রকর্ষবিদ। দেশের কৃতিসন্তান এই মহান মানুষটির বিদেহ আত্মা চিরশান্তিতে থাক এই প্রার্থনা করছি।
* তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, অর্থমন্ত্রনালয়ের ওয়েভসাইট, বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও নিউজপোর্টাল
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
মন্তব্য করুন