ডেস্ক রিপোর্ট। দি সিলেট পোস্ট
ভোজ্যতেল নিয়ে আমদানিকারক ও উৎপাদক ছয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কারসাজির প্রমাণ পাওয়া গেছে। অতি মুনাফা করতে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেট বাজারে তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এতে কৃত্রিম সংকটের সৃষ্টি হয়। হু হু করে বেড়ে যায় দাম। অস্থির হয়ে ওঠে ভোজ্যতেলের বাজার। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে এসব তথ্য। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
গত মার্চে হঠাৎ করেই বাজারে ভোজ্যতেল একরকম উধাও হয়ে যায়। ওই সময় প্রতিলিটার ১৭৫ থেকে ২১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সরকারের বেঁধে দেওয়া দর ছিল ১৬৮ টাকা। এই বাড়তি চলে প্রায় এক মাস। এই সময়ে কমপক্ষে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় ওই সিন্ডিকেট। তেল ইস্যুতে সরকারকে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।
তাই নৈরাজের কারণ খুঁজতেই মাঠে নামে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তদারকি দল। খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের সঙ্গে মিলগুলোতেও অভিযান চালায়। সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ২৪ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি জমা দেওয়া হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়-আন্তর্জাতিক বাজার, ইউক্রেন যুদ্ধ ও রমজান মাসকে ইস্যু করে দাম বাড়ানোর সুযোগ নেয় আমদানিকারক ও উৎপাদক ছয় প্রতিষ্ঠান। অতি মুনাফা তুলতেই পরিশোধন প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে বাজারে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দেয়।
ফলে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারাও সুযোগ নেয়। তখন বাজারে এক প্রকারের কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। খোলা ও বোতলজাত তেল বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। ওই সময় প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ২১০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সে সময় ক্রেতাদের এক প্রকার জিম্মি করে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটি বাড়তি দরে কিনতে বাধ্য করে।
এদিকে দাম কমাতে সরকারের পক্ষ থেকেও নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রোজা ও ঈদ উপলক্ষ্যে ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার সয়াবিন ও পাম অয়েল আমদানির ওপর ১০ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং বিপণন পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে। এর আগে এলসি কমিশন ও মার্জিন প্রত্যাহার করা হয়। এরপরও বাজারে তেলের দাম কমেনি। এসব সুবিধা দেওয়ার পর গত ২০ মার্চ তেলের দাম প্রতি লিটার ১৬৮ টাকা থেকে ৮ টাকা কমিয়ে ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ওই দরে বাজারে তেল পাওয়া যাচ্ছে না। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা বাজারে অভিযান চালিয়ে বেশি দামে বিক্রির প্রমাণ পেয়েছে।
ভোক্তা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সিটি এডিবল অয়েলের কারখানায় মেয়াদোত্তীর্ণ সাপ্লাই অর্ডার (এসও) পাওয়া যায়। পাশাপাশি ওই কারখানা থেকে তেলের সরবরাহ কমানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ এডিবল অয়েল কোম্পানি বন্ধ রাখে খোলা তেলের সরবরাহ। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে কমিয়ে দেয় সরবরাহ। শবনম ভেজিটেবল অয়েলে মেয়াদ উত্তীর্ণ এসও পাওয়া যায়। জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়।
পাশাপাশি সরকারি নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কনজুমার্স প্যাক বা বোতলজাত তেল মজুত করে এস আলম সুপার এডিবল অয়েল। কমিয়ে দেওয়া হয় সরবরাহ। কারসাজি করতে প্রতিষ্ঠানটি রিফাইনারি ইউনিট বন্ধ রাখে। কারখানায় মেয়াদোত্তীর্ণ সরবরাহ অর্ডার পাওয়া যায়।
এছাড়া অত্যাবশকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ আইনেরও ব্যত্যয় পাওয়া যায়। আর অপরিশোধিত তেলের মজুত থাকা সত্ত্বেও জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির অপেক্ষায় মার্চে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়। যদিও তারা সংস্কারের কারণে কারখানা বন্ধ রাখা হয় বলে ওই সময়ে জানিয়েছিল।
মেঘনা ও ইউনাইটেড এডিবল অয়েলও অত্যাবশকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক আইনে ব্যত্যয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে কমিয়ে দেয় তেলের সরবরাহ। পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ এসও পাওয়া যায়। বসুন্ধরা অয়েলে খোলা ভোজ্যতেলের মজুত পায়নি তদন্ত টিম। কারখানায় ফেরুয়ারি মাসের কনজুমার্স প্যাক পাওয়া যায়। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে ভোজ্যতেলের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া প্রমাণ পাওয়া যায়। পাশাপাশি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক আইন ব্যত্যয় পাওয়া যায়।
কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি। তাই সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বাজারে অস্থিরতা দূর হয়নি। প্রকৃতপক্ষে কারা কারসাজি করছে তাদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ভোজ্যতেল নিয়ে যারা কারসাজি করেছে তারা চিহ্নিত। তাদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বিশ্লেষণ করা হবে। পরে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা মন্ত্রণালয় ঠিক করবে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে আবারও সয়াবিনের দাম বাড়ানোর জন্য মিল মালিকরা উঠেপড়ে লেগেছে। তারা গত বুধবার (৬ এপ্রিল) জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে একটি বৈঠক করে তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। কিন্তু ভোক্তা অধিদপ্তর ওই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গেই নাকচ করে দেয়। তখন অধিদপ্তর বলে, ঈদের পরে এ বিষয়ে আবার বৈঠকে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ভোক্তা অধিদপ্তর দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করে দিলে গত বুধবার থেকেই বাজারে আবারও সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার অনেক বাজারে ৫ ও ২ লিটারের বোতল পাওয়া যায়নি। ১ লিটারের বোতল পাওয়া গেলেও তা ছিল চাহিদার তুলনায় অনেক কম। খোলা সয়াবিন তেল পাওয়া গেলেও বিক্রি হয়েছে সরকারের নির্ধারিত দরের চেয়ে প্রায় ৪০ টাকা বেশি দামে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, খোলা সয়াবিনের দাম বেশি হওয়ায় বোতল থেকে তেল ড্রামে ঢেলে খোলা হিসাবে বিক্রি করা হচ্ছে। কারণ ক্রেতাদের বড় একটি অংশ সক্ষমতার অভাবে এখন খোলা তেল কিনছেন। ফলে ব্যবসায়ীদের এতে মুনাফা বেশি হচ্ছে। খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা লিটার দরে বিক্রির কথা থাকলেও বাজারে যেগুলো পাওয়া যাচ্ছে তা ১৭০ টাকার কমে বিক্রি করছে না দোকানদাররা। খোলা সয়াবিন তেল ১৩৬ টাকা লিটার বিক্রির কথা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা দরে।
মন্তব্য করুন