হবিগঞ্জ প্রতিনিধি
২৬৩৬.৫৮ বর্গকিলোমিটার আয়াতনের হবিগঞ্জ জেলায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের বসবাস। এ জেলায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করে ৭৯২ জন মানুষ। আর এসব মানুষের চিকিৎসার একমাত্র শেষ আশ্রয়স্থল ২৫০ শয্যা হবিগঞ্জ জেলা সদর আধুনিক হাসপাতাল।
হাসপাতালটির অধিনে রয়েছে জেলার একমাত্র লাশ কাঁটা ঘর বা মর্গ। প্রতিদিনই জেলার ৯টি উপজেলার কোন কোন এলাকা থেকে এই মর্গে এক অথবা তার অধিক লাশ নিয়ে আসা হয় ময়না তদন্তের জন্য। আর এখানে এসেই বিরম্বনায় পড়তে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসহ মরদেহের সাথে আসা স্বজনদের। নামে আধুনিক হাসপাতাল হলেও মর্গে নেই আধুনিকতার ছিটেফেঁটাও।
একমাত্র মর্গটিতে যেমন নেই ফ্যান, বাতি কিংবা ফ্রিজিং ব্যবস্থা তেমনি নেই লাশ কাঁটা ছেড়ার করার জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। মান্দাতার আমলে ভুঁতা দা চাকুসহ যন্ত্রপাতি দিয়েই কাঁটাছেড়া করা হচ্ছে লাশের। এছাড়াও মর্গটিতে নেই সরকারীভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ডোমও।
সরেজমিনে মর্গ ঘুরে দেখা যায়, মর্গটিতে কোন ধরণের উন্নতমানের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। পর্যাপ্ত ফ্যান, বাতি ও পানির সুব্যবস্থা না থাকাসহ নেই ফ্রিজিংয়ের কোন ব্যবস্থা। ফলে একদিন মর্গে কোন লাশ পড়ে থাকলেই দেখা দেয় দুর্গন্ধ। নষ্ট হয়ে যায় আশপাশের এলাকার পরিবেশ। একই সাথে শঙ্কা দেখা দেয় মরদেহের আলামত নষ্টের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিকাল ৪ টার পরেই কোন লাশ নিয়ে এলে এখানে ময়না তদন্ত করা হয় না। পর্যাপ্তপরিমান সুযোগ সুবিধা না থাকায় বন্ধ থাকে কাটাছেড়া কার্যক্রম। ফলে বাধ্য হয়েই এখানে কোন কোন লাশ একদিন অথবা দুইদিন পড়ে থাকে। গত (২ এপ্রিল শনিবার) সড়ক দূর্ঘটনায় র্যাব-৯ শায়েস্তাগঞ্জ ক্যাম্পের এক সদস্য মারা যান। মর্গে ফ্রিজিং না থাকায় লাশ পঁচে যাওয়ার আশঙ্কায় মৌলভী বাজার থেকে লাশবাহী ফ্রিজিং গাড়ি এনে রাখা হয়। এমতাবস্থায় এমন বিরম্বনার শেষ কোথায় তা জানা নেই কারো।
এদিকে ফ্যান, বাতি কিংবা শুধু ফ্রিজিং ব্যবস্থা নয় ময়নাতদন্ত শেষে গুরুত্বপূর্ণ আলামত রাখার জন্য যেসব বোতলে রাখা হয় সেগুলোও অনেক পুরোনো। একেকটা বোতলে রাখা হয় একাধিক আলামত। যার ফলে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে ব্যাঘাত ঘটারও আশঙ্কা থেকে যায়। এছাড়াও মর্গটির প্রধান ডোম ছাবু মিয়া ও তার সহযোগী তাজুল ইসলাম মারা যাওয়ার পর থেকেই ডোম শূণ্য হয়ে পড়ে মর্গটি। যদিও ছাবু মিয়ার ছেলে জিতু মিয়া ও তার সহযোগী রিপন মিয়া অতি কষ্টের মাধ্যমে তার বাবার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে। দিনের পর দিন কাজ করলেও সরকারী ভাবে সামন্যতম সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছে না তারা। লাশ কাটার পর স্বজনদের কাছ থেকে ৫শত থেকে হাজার যা পাচ্ছে তা দিয়েই সংসার চালাতে হচ্ছে তাদের। এমতাবস্থায় মর্গের সাথে তাদেরও মানবেতর জীবন কাটছে।
স্ত্রীর লাশ মর্গে নিয়ে আসা বেকারি শ্রমিক ইউসূফ আলীসহ একাধিক ভোক্তভূগির সাথে আলাপ করলে তারা জানান, সন্ধ্যার পর যদি কোন লাশ এখানে নিয়ে আসা হয় তা হলে মর্গে কোন মতে নিয়ে তারা রেখে আসে। নেই কোন পাহারার ব্যবস্থা। কবে কখন লাশের ময়না তদন্ত হবে তাও জান যায় না ঠিকমতো। ফলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয় তাদের। এছাড়াও যারা লাশ মর্গ থেকে গাড়িতে উঠানামা করানো বা যারা কাটাছেড়া করে তাদেরকেও দিতে হয় টাকা। সরকার যদি তাদেরকে বেতনসহ সুযোগ সুবিধা দিতো তা হলে হয়তো তারা আমাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা নিত না।
ডোম জিতু মিয়া জানায়, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমিই এখানে কাজ করছি। কিন্তু বছরের পর বছর গেলেও এখনও পর্যন্ত আমাদেরকে কোন বেতন ভাতা দেয়া হয় না। তাই লাশের সাথে আসা স্বজনরা যে যত দেয় তাই দিয়ে আমাদেরকে সংসার চালাতে হয়।
জিতু বলেন, বর্তমানে সব কিছু উন্নত হচ্ছে। কিন্তু এই মর্গের দিকে নজর নেই কারো। ফ্যান, চাকু, বাতির স্বল্পতার পাশাপাশি নেই পানির সরবরাহের ব্যবস্থা। বিশেষ করে ফ্রিজিং ব্যবস্থা না থাকায় দুই তিন দিন পুর্বের লাশ এখানে রাখা হলে বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তাই মর্গটির দিকে কর্তাব্যক্তিদের বিশেষ নজর দেয়ার অনুরোধ তার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ২৫০ শয্যা হবিগঞ্জ জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে (আরএমও) মো. মমিন উদ্দিন অকপটে স্বীকার করে নেন সব সমস্যার কথা।
তিনি বলেন, আমাদের মর্গে আধুনিক যন্ত্রপাতি কি কোন সুযোগ সুবিধাই নেই। তবে হিমাগারসহ সকল সমস্যার বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।
এছাড়াও ডোম না থাকার বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আপাতত জিতুসহ দুইজন কাজ করছে। যেহেতু নিয়োগ কার্যক্রম বিষয়টি সরকারের তাই এখানে আমাদের তেমন কিছু করার নেই।
মন্তব্য করুন