ত্যাগী রাজনীতিবিদরা হেরে যাচ্ছে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাছে ||


দ্যা সিলেট পোস্ট প্রকাশের সময় : সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২১, ১২:৫৯ পূর্বাহ্ন /
ত্যাগী রাজনীতিবিদরা হেরে যাচ্ছে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের কাছে ||

মাহবুবুল আলমঃ দিনে দিনে ত্যাগী ও পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদরা নির্বাচনের মনোনয়ন পাবার ক্ষেত্রে হেরে যাচ্ছে। হেরে যাচ্ছে টাকার খেলার কাছে। যার কারণে অদূর ভবিষ্যতে ত্যাগী ও পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদরা রাজনীতিবিমুখ হয়ে গেলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। এটাকে আমাদের চিরাচরিত রাজনীতির জন্য অশনি সংকেত বলেই মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।

এ-বিষয়ক পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলার আইনসভায় ব্যবসায়ী সদস্যের সংখ্যা ছিল চার শতাংশের মতো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রথম জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী পেশার অংশগ্রহণ ছিল ১৭ শমিক ৫ শতাংশ, বর্তমানে জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ ৬২ শতাংশ। জাতীয় সংসদে এভাবে ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার ফলে দেশে সুশাসন, নীতি নির্ধারণ কিছুই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ না করে, ব্যবসায়িক স্বার্থ নিয়ন্ত্রণ করছে।

১৯৯০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পেশাজীবী হিসেবে ব্যবসায়ীরা শীর্ষে উঠে আসেন।সেসময় আওয়ামী লীগ ত্যাগী ও পোড়খাওয়া নেতাদের মনোনয়ন দেয় বিপরীতে একটি প্রায় অসংগঠিত দল বিএনপি টাকাওয়ালা শিল্পপতি ও সামরিক এবং বেসামরিক অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের বেছে বেছে মনোনয়ন দিয়ে বাজিমাত করে, যদিও সে নির্বাচনে সুক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ ছিল। তারপর ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগও শিল্পপতি এবং সামরিক বেসামরিক অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের মনোনয়ন দিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে।

এরপর থেকেই টাকার কাছে হারতে শুরু করেছে রাজনীতি। দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও মনোনয়নে শিল্পপতি ও ব্যাবসায়ীদেরই গুরুত্ব দিচ্ছে। রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন ঘটার কারণে অনেক সৎ ব্যবসায়ীও চাইছেন, রাজনীতিতে যোগ দিয়ে ক্ষমতায়ন ঘটিয়ে পেশাগত স্বার্থ সংরক্ষণ করতে। রাজনীতিকরাও ব্যবসায় ঝুঁকছেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নিজের অস্তিত্বকে সুরক্ষিত করতে। এমন রাজনৈতিক আবর্তনে শেষ পর্যন্ত টাকার কাছে রাজনীতি বাঁধা পড়ছে। অবস্থা এমন হয়েছে, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ পর্যন্ত এ প্রবণতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ৬ অক্টোবর ২০১৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদ বলেছিলেন, ‘আমাদের গ্রামে প্রবাদ আছে গরিবের বউ নাকি সবারই ভাউজ (ভাবি)। রাজনীতিও হয়ে গেছে গরিবের বউয়ের মতো। যে কেউ যে কোনো সময় ঢুকে পড়তে পারেন, বাধা নেই।’ আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের দিকে তাকালে এ কথা অস্বীকার করার অবকাশ নেই, কারণ আমাদের রাজনীতি আজ বহুলাংশে অরাজনীতিবিদদের করায়ত্তে। আরও ভেঙে বললে, আমাদের রাজনীতির নাটাই আজ বলতে গেলে ব্যবসায়ীদের হাতে।

মাননীয় রাষ্ট্রপতি ‘যেভাবেই হোক’ ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যাওয়া রাজনীতিকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করার আশা করছেন। বলেছেন, ‘সততা বজায় না রাখলে একজন রাজনীতিবিদ কিছুই করতে সক্ষম হবেন না। কেউ যদি অর্থবিত্ত করতে চান, তাহলে তাঁদের জন্য অনেক উপায় আছে। তাঁদের রাজনীতিতে আসা উচিত না।’ দীর্ঘ ৫০ বছর যিনি শুধু রাজনীতিই করে গেছেন, রাজনীতির বর্তমান দশায় তাঁর কষ্টটা বুঝতে কষ্ট হয় না।

বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত তথ্য ও সংসদ সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে নির্বাচিত ৩০০ এমপির ২০৬ জনেরই পেশা ব্যবসা। ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেওয়া হলফনামা পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, চলতি সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যেও ব্যবসায়ী বেশি।

রাজনৈতিক বিশ্নেষকরা বলছেন, নির্বাচন দিন দিন ব্যয়বহুল হচ্ছে। এ কারণেই রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবসায়ীদের অধিক সংখ্যায় মনোনয়ন দিচ্ছে। এবারের নির্বাচনে বড় দু’দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ২৫৯ ও ২৪১ আসনে প্রার্থী দিয়েছে। একটি গবেষণা পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ২৮৬ থেকে ৩০০টি আসনে বড় দু’দলের নেতৃত্বাধীন জোট প্রার্থীদের প্রায় ৬২ শতাংশ প্রার্থীই ব্যবসায়ী। তৃণমূলে রাজনীতি করা নেতাদের মনোনয়ন না দিয়ে দলগুলো বেছে নিয়েছে আগে থেকেই ব্যবসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত নেতাদের পরিবারের কাউকে। রাজনীতিতে অবদান না থাকলেও কিংবা প্রাথমিক পর্যায় থেকে রাজনীতি না করলেও তাদের ‘উদারহস্তে’ টিকিট দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো।

তবে সংসদে ব্যবসায়ীদের জয়ী হয়ে আসা যে হারে বাড়ছে এবং অন্যদিকে বিভিন্ন পেশাজীবীর সংখ্যা যে হারে কমছে, তা বিশেষ পর্যালোচনার দাবি রাখে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ব্যবসায়ী এমপির সংখ্যা ছিল ১৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি এমপি-রাজনীতিক এসেছিলেন আইনজীবীদের মধ্য থেকে- ৩১ শতাংশ। ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় সংসদে ব্যবসায়ী ছিল ২৪ শতাংশ। এর পর ১৯৯০-এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদে ব্যবসায়ীরা শীর্ষে উঠে আসেন। ৩৮ শতাংশ ব্যবসায়ী নির্বাচিত হন এ সংসদে। এর পর ১৯৯৬ সালের সংসদে ৪৩ শতাংশ, ২০০১ সালে ৫৮ ও ২০০৮ সালে ৫৭ শতাংশ ব্যবসায়ী এমপি নির্বাচিত হয়ে পেশাগত শীর্ষস্থান অব্যাহত রাখেন। অন্যদিকে, ২০১৪ সালে আইনজীবীর সংখ্যা মাত্র ১০ শতাংশে নেমে আসে, যা ১৯৭৩ সালে ছিল ৩১ শতাংশ।

একইভাবে সংসদে অন্যান্য পেশাজীবীর সংখ্যাও ক্রমে কমেছে। কৃষিজীবী পেশা থেকে নির্বাচিত এমপি প্রথম জাতীয় সংসদে (১৯৭৩) ছিল ১১ শতাংশ। দ্বিতীয় সংসদে (১৯৭৯) তা কিছুটা বাড়লেও (১৩ শতাংশ) এর পর ক্রমেই কমেছে। কৃষিজীবীর মধ্য থেকে ১৯৯০ সালে ১১ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৮, ২০০১ ও ২০০৮ সালে ৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে মাত্র ৫ শতাংশ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। (তথ্যসূত্র : দৈনিক সমকাল)

সংসদে ব্যবসায়ীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, বেড়েছে কোটিপতি এমপির সংখ্যাও। দশম সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ৩০০ এমপির হলফনামা বিশ্নেষণ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জানাচ্ছে, বর্তমান এমপিদের ২২৬ জন কোটিপতি। ৬৫ শতাংশের বেশি এমপির কোটি টাকার বেশি সম্পদ রয়েছে। সম্পদের বাইরে আয় বিবেচনায় ৫৫ এমপির বার্ষিক আয় কোটি টাকার বেশি বলে দেখা গেছে এ গবেষণায়। তাদের স্ত্রী- সন্তানরাও বিপুল সম্পদের মালিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সমকালকে বলেছেন, আদর্শিক রাজনীতির জায়গায় অর্থনির্ভর রাজনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। একটা সময়ে আদর্শিক রাজনীতিরই প্রাধান্য ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই রাজনীতি করেছেন। এখন অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। রাজনীতি ও নির্বাচন দুটোই অর্থনির্ভর হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শামীম রেজার মতে৷ ‘‘বাংলাদেশে নানা রাজনৈতিক উত্থান পতনের পরও যারা পেশাদার রাজনীতিবিদ তাদের প্রাধান্য রাজনীতিতে ছিল৷ তবে গত দুই-তিনটি সংসদের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখবো যারা দীর্ঘদিন রাজনীতিতে আছের তাদের জায়গায় অন্য পেশাজীবীরা চলে এসেছেন৷ আছেন আমলারা৷ এখন প্রশ্ন উঠতে পারে অন্য রাষ্ট্রেতো প্রেসিডেন্টও হচ্ছেন ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে৷ তারা আসলে একটি রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে হচ্ছেন৷ আমাদের এখানে ব্যবসায়ী বা আমলারা যখন সিদ্ধান্ত নেন তারা তাদের স্বার্থে নেন৷ জনগণের কথা ভাবেননা৷ যারা ভাববেন সেই প্রকৃত রাজনীতিবিদরা এখন গৌণ৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ব্যবসা করে অল্প সময়ের মধ্যে রাজনীবিদ হওয়া, দীর্ঘদিন আমলা থেকে বা কোনো বাহিনীতিতে কাজ করে রাজনীতিতে অল্প সময়ে প্রভাবশালী হওয়া কোনো ভালো লক্ষণ না৷ রাজনীতিবিদরা যে রাজনীতি পরিচালনা করার কথা সেটা না থাকা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাশিত নয়৷ আমার মনে হয় এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে তা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য খারাপ খবর৷”

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রাজনীতিতে রাজনীতিবিদগণ সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন। অর্থাৎ রাজনীতি এখন রাজনীতিবিদদের জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান সাহেবের কথা মনে পড়ছে। তিনি ইংরেজিতে বলেছিলেন,’ I will make politics difficult for the politicians যা বাংলা করলে দাঁড়ায়- ‘ আমি রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তোলবো’ সেই থেকে রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন হতে শুরু হয়েছিল সে ধারা এখনো অব্যাহত আছে। রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই, রাজনীতি এখন অনেকটাই ব্যবসায়ী ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক এবং বেসামরিক আমলাদের হাতে চলে গেছে।

রাজনীতির যতটুকু অস্তিত্ব টিকে আছে অদূর ভবিষ্যতে এর গন্তব্য কোথায় তা যেনো কারো জানা নেই। দেশের প্রথম সারির কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে টাকার বস্তাওয়ালা ব্যবসায়ী ও সামরিক এবং বেসামরিক অবসরপ্রাপ্ত আমলাদেরই বেছে বেছে মনোনয়ন দিচ্ছে। আর এই টাকার কাছেই মার খেয়ে যাচ্ছেন ত্যাগী, পোড়খাওয়া, সৎ এবং পেশাদার রাজনীতিবিদরা। একবারও কেউ ভাবছে না রাজনীতিবিদদের হাত থেকে রাজনীতি সরে গেলে দেশের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? ভোটের হিসাব-নিকাশে এই অরাজনৈতিক শক্তি যেভাবে ঢুকে পড়ছে তার চূড়ান্ত পরিনতি দেশের জন্য কতটা মঙ্গলজনক হবে তা ভবিতব্যই বলতে পারে।

তবে একথাও ঠিক যে নির্বাচনে আলোচিত ব্যবসায়ীরা নির্বাচনে যেভাবে বস্তা বস্তা টাকা নিয়ে মাঠে নামে নির্রাচিত হয়ে এমপি-মন্ত্রী হচ্ছেন, এই ব্যবসায়ীরা রাজনীতিকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যবসায় স্বার্থে ব্যবহার করলেও তাদের কিছুটা হলেও মানুষের কথা ভাবতে হয়। আর একথাও সত্য যে এখন টাকা ছাড়া ভোটে জিতে আসা অনেকটা অসম্ভব হয়ে ওঠেছে।

পরিশেষে বলতে চাই এখন যেভাবে রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে রাজনীতি ফসকে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ কী হবে তা কেউই বলতে পারছে না এবং বলাও সম্ভব নয়। দেশের রাজনীতি সচেতন নাগরিকরা মনে করছেন মনোনয়নের ক্ষেত্রে সব  দলকেই ভারসাম্যমূলক নীতি গ্রহণ করা উচিত এবং তা অবশ্যই তা করতে হবে যুক্তিযুক্তভাবে।

লেখকঃ কবি, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক