আহমদ সিরাজ
প্রাগৈতিহাসিক-ঐতিহাসিক কালের হিসেবে মনুষ্য প্রজাতির এই গ্রহে বিচরণ ও তার বেঁচে থাকা কালের হিসেবে এখন পর্যন্ত সুমাচার, কৃতি-কৃতিত্ব ও গৌরবের। মহাপ্রকৃতির রাজ্যে প্রাণিজগতে মানুষের এভাবে টিকে থাকাটাকে অন্য প্রাণীদের থেকে শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করে। এজন্য পশুপাখি সহজেই পশুপাখি কিন্তু মানুষ তা নয় বলে আজ ও আগামীকালের মানুষ এক নয়। মানুষের এমন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিশীলতার কারণে প্রাণিজগৎ থেকে পৃথক হয়ে এই গ্রহের প্রাণী হয়ে গ্রহের বাইরেও তার খোঁজ-খবর নিতে কেবল চেষ্টাই করছে না― মানুষ মহাবিশ্বনামক জানা-অজানা সমস্ত কিছুই জেনে নিতে প্রাণান্তকর চেষ্টারও পিছু ছাড়ছে না। মানুষ জানে তার এমন সব চেষ্টার ভিতর দিয়ে বিরাট অঘটনও ঘটে যেতে পারে, তবুও ভীতিতে তাড়িত নয়। মানুষ সৃষ্টির ভিতর সৃষ্টি কতদূর বিস্তৃত, জগৎ মহাজগৎ তা জানার দুর্মর তাড়নায় তাড়িত। এখানে মানুষ সসীম-অসীম বেড়াজালে সীমাবদ্ধতার কাছে হার মানতে রাজি নয় যেন।
বিবর্তন বা ক্রমবিকাশের ইতিহাস জানান দিচ্ছে গুহামানুষ থেকে গৃহের মানুষ― অধুনা সভ্য মানুষ হিসেবে পৃথিবী নামক গ্রহে মানুষের বসবাস প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। এমন মানুষের ব্যক্তির মাঝে সমষ্টির কিংবা সমষ্টির মাঝে ব্যক্তির অবস্থান যেভাবেই বিবেচনা করা হোক না কেন আগামীর মানুষ সম্পর্কে সহজ ভাবনা সহজ নয়। পৃথিবী নামক গ্রহ যে মানুষের শেষ ঠিকানা― জন্মমৃত্যুর ইতি ঘটার এমন নিশ্চিন্ত চিন্তায় স্থির থাকা যায় না। মানুষের উদ্ভাবনী বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি পৃথিবী নামক গ্রহের স্থিতি, ধ্বংস, বিলুপ্তি বা মহাজাগতিক প্রস্থান যা-ই ঘটুক মানুষ গ্রহের বাইরে কোথায় মহাবিশ্বের ঠিকানা খুঁজে নিয়ে তার অস্থিত্ব রক্ষা বা তাকে ভিন্ন পর্যায়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী।
এরকম ভাবনার মানুষের গ্রহের মানুষ হলেও তার জন্মমৃত্যুর হিসাব কীভাবে সম্পাদিত হবে তাতে সিলমারা জবাব দেওয়া যায় না। গ্রহের একটা বড় অংশের মানুষ পাপপুণ্য দ্বারা তাড়িত। তারা জন্মমৃত্যুর ভিতরও এসব খুঁজে দেখে এজন্য তার কাছে মৃত্যুভয় থাকলেও জন্মের আনন্দে তাড়িত এবং পাশাপাশি মৃত্যুঞ্জয়ী হওয়াতেও কম সাহসী হয়ে উঠছে না। মানুষ সৃষ্টিশীল বলে তার সৃষ্টিকর্ম অনাগত সময়েও রাখতে চায়। মানুষের কাছে তাই জন্মমৃত্যু মহিমান্বিত। মানুষ যেভাবেই অবস্থান করুক― পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় জীবন কিংবা আরও বিস্তৃত পরিসরে হলেও ব্যক্তিমানুষ তাকে নন্দিত করে রাখতে চায়। লেখক, কবি, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক প্রভৃতি সৃষ্টিশীল মানুষের জীবন গুরুত্ব পেলেও অধুনা নাগরিক জীবনও নিজেকে নন্দিত অবস্থানের বাইরে রাখতে আগ্রহী নয়। বিশেষত তথ্য ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি মানুষের নানানমুখী বিকশিত প্রবণতা তৈরি হচ্ছে― যা এখন অনুমানেরও বাইরে।
বাংলাদেশ এই পৃথিবী নামক গ্রহের অংশ। তারাও সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় তাড়িত। মানুষ তার বহু প্রবণতার মধ্যে নিজেকে চিহ্নিত করে রাখতে জন্মদিন সন তারিখ হিসেবে পালন করে। ঘরে-বাইরে বিচিত্র আড়ম্বর অনুষ্ঠানের মধ্যে তা পালন করতে গিয়ে নিজেকে দশজনের মধ্যে একজন বা তা থেকে পৃথক হিসেবে চিহ্নিত করে রাখতে চেয়েছে। এই প্রবণতার দৌড়েও যেন একটা প্রতিযোগিতার মতো হয়ে উঠেছে। এইসব পালনের মধ্য দিয়ে যেমন শুভবার্তা আসে তেমনি বাড়াবাড়ি, বিড়ম্বনা, ব্যক্তিসর্বস্বতার জায়গা দখলের মতো অবস্থানেরও প্রবণতা আছে। সর্বোপরি মানুষ পৃথিবীতে একটা পজিটিভ সত্তা। ধ্বংস ও বিনাশের মাঝে মানুষ মঙ্গলবোধ দ্বারা যেমন তাড়িত তেমনি অমঙ্গলবোধও নিত্য সঙ্গীর মতো। এই অর্থে প্রকৃত মানুষ শুভবার্তার ফেরিওয়ালা। মানুষের জন্ম সত্যিকার অর্থে উজ্জীবনের, গতির― পথের নিশানাও বটে। জগৎ-সংসার বিচিত্র লীলাময় গতিময়তা বহন করে এগিয়ে চলেছে― মানুষ তার সারথী হয়ে উঠছে যেন। তাই মানুষের জন্ম ও মৃত্যু আনন্দ-বিষাদের মতো হলেও দুটোতেই সৃজনকর্মে ভরপুর বলে মানুষ তা থেকে শক্তি খুঁজে পায়। জন্মদিনের মাহাত্ম্যও তাতে নিহিত। মৃত্যু নিঃশেষ হওয়া অর্থে বুঝে নিলেও তাতেও ব্যক্তির সৃজনক্ষমতা নিঃশেষ হয় না। মানুষ তা বংশ পরম্পরায় বয়ে নিয়ে জ্ঞাতসারে ও অজ্ঞাতসারে বেঁচে থাকতে চায়। তাই মানুষ জীবনের শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও জন্মমৃত্যুর নান্দনিকতায় কাল থেকে কালান্তরে এভাবেই অনুপ্রাণিত হয়েছে।
বিদ্যমান অবস্থার প্রভাব-স্বভাবের বাইরে একজন আহমদ সিরাজের ৬৬ বছর অতিবাহিত হচ্ছে। তাতে তিনি তাকে নন্দিত করার গরজ বোধ এতদিন না করলেও তার পরিবার, স্বজন, প্রিয়জন বিদ্যাবুদ্ধিতে অন্য দশজনের মতো ভাবনা থেকে এখন জন্মদিনের প্রভাবে তাড়িত। এবছর পরিবার, স্বজন, প্রিয়জনদের কাছ থেকে বুদবুদের একটা তাড়না গড়ে উঠলেও ১৮ জানুয়ারি ২০২২ তিনি (আহমদ সিরাজ) সড়ক দুঘর্টনায় গুরুতর আহত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় ১ মার্চ ২০২২ তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানটি হুমকিতে পড়ে স্থগিত।
তার জন্মদিনের অনুষ্ঠান পালনের তার তেমন বলবৎ আগ্রহ না থাকলেও সুহৃদ ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে কিছু কিছু লেখা বাতাসেই চলে আসে। যদিও এগুলো জন্মদিন হিসেবে না হলেও সুশোভিত। আন্তরিক টানেই তৈরি হয়েছে। তিনি অনুষ্ঠান সর্বস্বতার চাইতে তার মর্যাদা দিতে চান।
৬৬তম জন্মদিনের এমন ইচ্ছার বারান্দাটা এভাবেই থেকে গেল সময়ের হাতে।
তারিখ: ১/০৩/২০২২ খ্রি.
মন্তব্য করুন