Joyosree Mohan Talukder.
সারাদিন আজ আকাশ মেঘে ঢাকা। সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। আর মাত্র ২ দিন মীরা নাটোরে থাকবে।এই দুদিনের মধ্যেই মীরাকে যেতে হবে জগদীশপুর গ্রামে। হাবিব ও কুদ্দুস চাচা অপেক্ষা করছে মীরাকে এক নজর দেখার জন্য। মীরার জন্ম হয়েছিল এই জগদীশপুর গ্রামে।তারপর দেখতে দেখতে কুড়িটি বছর কেটে গেছে।মীরা আর আগের মতো তঁার মায়ের জন্য মন খারাপ করে বসে থাকে না। মীরা বুঝতে শিখেছে যে সবকিছু চাইলেই পাওয়া যায় না। মায়ের জন্যই আজ সে ছুটে চলেছে জগদীশপুর গ্রামে।
দেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই মীরার পরিবারের মানুষ চলে যেতে থাকে ভারতবর্ষে। মাত্র চার ঘর থেকে যায় বাংলাদেশে। মীরার বয়স যখন সবে মাত্র ৩ দিন তখন মীরার মা মারা যায়। মীরা বড় হয় বাড়ির কাজের দিদি বিমলার কাছে। একদিকে মাযের ভালোবাসার অভাব অন্যদিকে আপন মানুষের অবহেলা নিয়ে বড় হতে হয় মীরাকে।
মাত্র তিন বছর বয়স থেকেই মীরার মধ্যে সবাই একটু অস্বাভাবিক আচরন খেয়াল করে। মীরা একা ঘরে ছায়ার সাথে কথা বলে। সারাদিন নেচে-গেয়ে দিন যায় ছোট্ট শিশু মীরার। এখন মীরা কুড়িতে পা দিয়েছে। ঢাকা শহরের
মোহাম্মদপুরে ১৯/২ নং বাসায় মাীরা থাকে। ইডেন কলেজের ছাত্রী সে। মায়ের বাবা মা আর বিমলাখালাকে নিয়ে মীরা ঢাকায় থাকে। মীরার মা মারা যাবার একবছরের মাথায় মীরাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় মামাবাড়ি। মীরার বাবা বিয়ে করে এক বিধবা মহিলাকে। সময় চলে আপন গতিতে। কিন্তু মীরাকে সবসময় কে যেন ডাকে জগদীশপুর গ্রামের খান পরিবারের চিলেকোঠার ঘরটি। নাটোর থেকে গাড়ি করে মীরা চলেছে জগদীশ পুর গ্রামে।
বিমলাদির কাছে থেকে মীরা শুনেছে তাঁর মায়ের মৃত্যুর গল্প। মারা যাবার দিন মীরাকে সারাদিন বুকের উপর রেখেছিল তাঁর মা। নিজ নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছিল মীরা। অতিরিক্ত জ্বর আর শ্বাসকষ্ট নিয়ে মারা যায় মীরার মা।মারা যাবার আগে তাঁর ইচ্ছে ছিল মীরার
বাবার সাথে একবার দেখা করা। কিন্তু শেষ দেখা করার আর সুযোগ হলো না মীরার বাবার। চলে গেল মোহনা
মীরাকে ছেড়ে। চিলে কোঠার ঘরটিতে জন্ম হয়েছিল মীরার। জগদীশ গ্রামের মানুষের মুখে মুখে শোনা যায় চিলে কোঠার ঘর নিয়ে নানান গল্প কাহিনী।
অনেক রাতে শোনা যায় কান্নার শব্দ। সবে বরাতের রাতে ধুপের গন্ধ আসে খান পরিবারের চিলে কোঠার ঘর থেকে।
জগদীশ পুর গ্রামের হিন্দুরা বলে ঐ চিলে কোঠার ঘরে এখনও মোহনার আত্না ঘুরে বেড়ায়। মীরার বাবা নাটোরে থাকে তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ও পুত্র সন্তান নাবিল কে নিয়ে। মীরাকে দেখে তাঁর বাবা খুব একটা খুশী হননা।কি যেন একটা বলতে চায় মীরাকে তাঁর বাবা কিন্তু আজও বলতে পারে না। দুজনের সম্পর্ক এখনও অনেকটাই অস্বাভাবিক।
মীরার গাড়ি গিয়ে থামে খান পরিবারের উঠানে।মীরা নামতেই গ্রামবাসীরা দলে দলে আসতে থাকে মীরাকে এক নজর দেখতে।মীরার ছোটচাচা পরিবার সহ থাকে জগদীশ পুরে। মীরাকে দেখেই রাহেলা নামে একজন বৃদ্ধা বলে এতো দেখতে একদম মোহনার মতো। কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে দোয়া পড়ে মীরার। রাত হতেই বাড়িতে জ্বলে ওঠে আলো। মীরা একঘর থেকে আরেক ঘরে যায়। মুসলিম ধর্মে ছবি তোলা নিষেধ। কিন্তু মীরা খুঁজে তাঁর মার ছবি।
মীরা যেতে চায় চিলেকোঠার ঘরে কিন্তু কুদ্দুস চাচা নিষেদ করে। আগে কখনো মীরা সে ঘরে যায় নি। বাড়ির সবাই বলত চিলেকোঠার ঐ ঘরে সাপ আছে। জন্মের পর থেকে মীরা বিমলাদির কাছে তাঁর মায়ের গল্প শুনত। মীরার পন মীরা এবার যাবেই মায়ের শেষ নি:শ্বাস ত্যাগের স্থানটি দেখতে।
কুদ্দুস চাচা ও বিমলাদি দুই জনে ছিল স্বামী স্ত্রী। বিমলাদি ছিল হিন্দু পাল ঘরের মেয়ে। জগদীশ পুর গ্রামে সেই সময় প্রচুর পালেরা বসবাস করত। সম্পর্কের বিয়ে ছিল তাঁদের মধ্যে। বিয়ে হবার পাঁচ বছরের মাথায় তাদের ঘরে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান। নাম দেয়া হয় রেহানা। কি অদ্ভুত মিল খুজে পায় মীরা আজ গতরাতে তাঁর দেখা স্বপ্ন আর চিলে কোঠার ঘরের মধ্যে। পুরো ঘর জুড়ে ছিল শুধু ময়লা আর ময়লা। মীরা এক পা দুপা করে ঘুড়ে বেড়ায় পুরো ঘর জুড়ে। কেউ সাথে নেই মীরার । মীরা একা আজ চিলে কোঠার ঘরে।
জানা যায় মীরার মা খুব কম কথা বলত। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেয়া ছিল তাঁর চরিত্রের প্রধান গুন।মীরার বাবা কোনদিন তাঁকে মন থেকে ভালো বাসেনি। আদর করে বুকে টেনে নেয় নি। সব সময় দোষ খুজে বেড়াত মীরার বাবা মীরার নানু বাড়ীর ও তাঁর মায়ের। মুখ বুঝে নির্যাতন সইত মোহনা। আজ মীরা বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়। গ্রামের সুন্দরী মেয়েদের প্রতি খান পরিবারের বড় ছেলে অর্থাৎ মীরার বাবার খারাপ নজর ছিল।রেহানা অর্থাৎ বিমলাদির মেয়ে বিয়ে দেবার তিন বছরের মাথায় ত্যাগ করে স্বামীর ঘর। যুবতী মেয়ে রেহানা বিমলাদির সাথে আসত খান পরিবারে মায়ের কাজে সহায়তা করার জন্য। কিন্তু ধীরে ধীরে রেহানা ও মীরার বাবার একটা অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠে যেটা মীরার বাবা শত চেষ্টা করেও ঢেকে রাখতে পারেনি। বিমলা দি মন থেকে চায় নি। কারন মোহনা কে বিমলাদি মেয়ের চেয়েও বেশী ভালোবাসতো।
সময় চলে আপন গতিতে। রেহানার যাতায়াত বাড়তে থাকে খান পরিবারে। মোহনা চোখের উপরে দেখে সবকিছু। কিন্তু বলতে পারে না। মোহনার সন্তান হয় না। এর জন্য মোহনার প্রাধান্য সংসারে কমতে থাকে। মতিন আর মোহনার সম্পর্ক শুধু রাতের বিছানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এইভাবেই মোহনা গর্ভবতী হয়। জন্ম নেয় খান পরিবারে মীরা। কিন্তু রেহানাকে পাবার আশায় মতিন তখন দিশেহারা। মোহনাকে মনে করে পথের কাঁটা। চিলে কোঠার ঘরে পরিকল্পনা করে মতিন মোহনাকে চিরতরে সরিয়ে দেবার। খাবার মধ্যে বিষ মিশিয়ে বিমলাদির হাতে দেয় মতিন। ছোটমেয়ে মীরার মুখ পর্যন্ত দেখে না মতিন।বিমলাদি খুব যত্ন করে মোহনাকে খাবার দেয়। কিন্তু খাবার খাবার পর থেকে শুরু হয় মোহনার শ্বাসকষ্ট ও অতিরিক্ত জ্বর।একদিন পরে ভোর রাতে মোহনা মারা যায়।
বিমলাদি বুঝতে পারেনা কেন মারা গেল মোহনা। পরে যখন জানতে পারে তঁার মেয়ে রেহানার কাছে থেকে তখন চিরতরে ত্যাগ করে বিমলাদি ও কুদ্দুস চাচা তঁার মেয়ে রেহানাকে। এতে অবশ্য তঁার মেয়ের কোন অসুবিধা হয় না। খুব আনন্দে বিয়ে করে খান পরিবারের বড় ছেলে মতিনকে। বিমলাদি মীরাকে বলে তঁার মার কবরে যাবার জন্য। চিলে কোঠার ঘরের পাশে ছিল একটা কুয়া। সেই কুয়ার পাশে মোহনাকে কবর দেয়া হয়। সবাই বলছিল খান পরিবারের পারিবারিক কবর স্থানে কবর দেবার জন্য কিন্তু মতিন সেটা দেয় নাই। কারন মৃত্যু টা কেন হলো এটা মতিনের জানা ছিল।
মীরাকে বিমলা দি চিলেকোঠার ঘর থেকে নিয়ে যায় তাঁর মা মোহনার কবরে।সেখানে গিয়ে মীরাকে সব কথা বলে কুদ্দুস চাচাও বিমলাদি।পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় মীরার।বিমলাদির বুকে মাঁথা দিয়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে মীরা।
মীরা স্থির করে বাবার মুখোমুখি হবে। কিছু প্রশ্নের উওর জানতে চাইবে। কিন্তু মীরা জগদীশপুর গ্রামে থাকতেই খবর আসে মতিন সাহেব মারা গেছে। নাটোর সদর হাসপাতালে মৃত মতিন সাহেবকে দেখতে যায় জগদীশপুর গ্রামের শত শত মানুষ। মীরার গাড়ি চলে নাটোর সদর হাসপাতালের দিকে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছানোর পর মীরা ডাইভারকে বলে গাড়ি চালানোর জন্য। মীরা নামবে না।দেখবে না তার জন্মদাতার মুখ। বিমলাদির বুকে মাথা দিয়ে মীরা নিজেকে স্হির রাখার চেষ্টা করে। সামনে ভেসে আসে তাঁর না দেখা মায়ের মুখ। বিমলাদি নিজের বুকের ভেতরে জড়িয়ে রাখে মীরা কে।গাড়ি চলে আপন গতিতে। গন্তব্য জানা নেই।
জয়শ্রী মোহন তালুকদার । সম্ভাবনাময়ী লেখিকা,
এরই মধ্যে দুই বাংলাই তার লেখা সমাদৃত।
মন্তব্য করুন