ডেস্ক রিপোর্ট। দি সিলেট পোস্ট।
হু হু করে বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম। বাজারে নাভিশ্বাস। নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্য দ্রব্যের পাশাপাশি বেড়েছে মোটা চালের দামও। এতে মহাবিপাকে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। প্রতিদিনের চালের খরচ যোগাতেই তারা হিমশিম খাচ্ছেন। পাঁচ-ছয়জনের একটি পরিবারের শুধু চালের খরচ যোগাতে হচ্ছে একশ টাকা। কিছুটা নাগালে থাকা মোটা চালের দামও ছুঁয়েছে পঞ্চাশের কোটা।
এ অবস্থায় সরকারের খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রমের ওপর ভরসা করছে এক শ্রেণির সাধারণ ভোক্তা। তবে সরকারের কাছে চালের পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরেও বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে তা পৌঁছাচ্ছে না অধিকাংশ ভোক্তার কাছে।
রামপুরা থেকে পূর্বদিকের পথে নবীনবাগে (সিপাহীবাগ এলাকা) অনেক নিম্নবিত্ত মানুষের বসবাস। সেখানে দুপুরে ছোট্ট একটি মুদিদোকানে সুরুজ হোসেন নামে একজন এসে জানতে চাইলেন, ‘মোটা চাল কত করে কেজি?’ দোকানি উত্তর দিলেন, পুরোপুরি ৫০ টাকা। দাম কিছুটা কমানোর জন্য সুরুজ মিয়ার তোড়জোরের পরে দোকানি বললেন; ‘ওএমএসের চাল খাও। সকালে ৩০ টাকায় পাবা।’
তখন সুরুজের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তিনি জানান, বাবা-মা সন্তানসহ ছয় জনের সংসারে প্রতিদিন গড়ে দুই কেজি চাল প্রয়োজন হয়। এজন্য ১০০ টাকা জোগাড় করতে খুবই কষ্ট হয় তার। সপ্তাহে দু-একবেলা কাটে না খেয়েই।
৩০ টাকা কেজিতে সরকারের দেওয়া ওএমএসের মোটা চালও কিনে খেতে পারেন না সুরুজ মিয়ার পরিবারের লোকজন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি রিকশা চালাই, বৌ খাবারের হোটেলে ঠিকা (দিন চুক্তিভিত্তিক) কাজ করে। ওএমএসের চাল কিনতে গেলে ট্রাকে দীর্ঘ লাইনের কারণে একবেলা কেটে যায়। কয়েক টাকা বাঁচাতে গেলে এক বেলার কামাই হবে না। তাই কেনা হয় না।’
সুরুজ মিয়ার এ পরিস্থিতি পুরো শহর বা দেশের চিত্র না-ও হতে পারে। তবে চালের দামের কারণে অধিকাংশ প্রান্তিক মানুষ চাপে রয়েছেন। বিশেষ করে দিনমজুর, রিকশা, ভ্যানচালকের মতো শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট বেশি।
রাজধানীর নিম্নবিত্ত শ্রেণির কয়েকজন জাগো নিউজকে জানান, তাদের সংসারের এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় চালের পেছনে। যা অন্য খরচের তুলনায় দ্রুত বাড়ছে। এখলাসুর রহমান নামে একজন সাইকেল মেকার সংসারের ব্যয় বাড়ার হিসাব দিয়ে জানান, চাল কিনতে মাসে তার দুই হাজার টাকা খরচ হয়, আর ঘরের ভাড়া দিতে হয় দুই হাজার ৮০০ টাকা। বিগত পাঁচ বছরে ওই ঘরের ভাড়া বেড়েছে ৩০০ টাকা। আর চালের দাম বেড়েছে মণপ্রতি ৫০০ টাকার বেশি।
এখলাসুর রহমানের কথার সত্যতা মিলেছে পরিসংখ্যানেও। তার পরিবারের যদি দুই হাজার টাকার চাল প্রয়োজন হয় তবে চাল লাগে ৪০ কেজি। আর পাঁচ বছর আগে খোলা বাজারে প্রতিমণ (৪০ কেজি) চাল ৫০০ টাকার কমই ছিল।
পরিসংখ্যার ব্যুরো ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চালের গড় দাম ৪০ টাকার নিচে ছিল। আর ১০ বছর আগে ২০১১-১২ সালে ছিল ৩৩ টাকা ২০ পয়সা। ১৫ বছর আগে ২০০৬-০৭ সালের দিকে ছিল ১৮ টাকা ৭৭ পয়সা।
সরেজমিনে রাজধানীর রামপুরা, মালিবাগ, শান্তিনগর ও সেগুনবাগিচা বাজার ঘুরে দেখা যায়, এসব বাজারে এখন স্বর্ণা-৫ ও গুটি স্বর্ণা জাতের মোটা চালের প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫২ টাকা কেজিতে। আর সরু চালের মধ্যে মাঝারি মানের (মিনিকেট ও শম্পা কাটারি) চালের দাম ৬২ থেকে ৬৬ টাকা। এর চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভালো মানের সরু (নাজিরশাইল ও জিরাশাইল) চাল, যা প্রতিকেজি ৬৮ থেকে ৭২ টাকা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে।
যদিও বাবুবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাজারে আমন মৌসুমের ধান স্বর্ণা ও গুটি স্বর্ণার সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় এসব চালের দাম কমছে। কিন্তু খুচরা বাজারে এসব মোটা চালের দাম কমার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
চালের দামে লাগাম দিতে সরকারও চেষ্টা করেছে। যদিও এর কার্যত সুফল নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে সব সময়। সরকার চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে ওএমএস ব্যবস্থায় চালের বিক্রি ব্যাপক হারে বাড়িয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত ১ জুলাই থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওএমএসের মাধ্যমে দুই লাখ ৩২ হাজার ৬২০ টন চাল বিক্রি হয়েছে। যা আগের বছরের একই সময়ের চারগুণ বেশি।
ওএমএসের কারণে দরিদ্র মানুষের চালের দাম কিছুটা হলেও স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানিয়ে খাদ্য সচিব ড. মোছাম্মাৎ নাজমানারা খানুম জাগো নিউজকে বলেন, এর সুফল মানুষ পাচ্ছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রচুর মানুষ কম দামে চাল কিনছে। তাতে সার্বিক বাজারে কিছুটা হলেও দাম কমেছে। না হলে আরও বাড়তে পারতো।
যদিও মোটা চালের দাম কমাতে ওএমএস খুব বেশি কার্যকর নয়, বরং এটি বাজারে সংকট তৈরি করছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থার পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ওএমএসের মাধ্যমে চালের বাজার স্থিতিশীল রাখা যাবে- এ ধারণা যৌক্তিক নয়। সার্বিক চাহিদার খুবই কম পরিমাণে চাল ওএমএসে বিক্রি করা হয়।
‘সরকারের চালের চাহিদার কারণে বাজারে চাপ তৈরি হচ্ছে। বাজারের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে এখন। আমদানি বাড়িয়ে হলেও বাজার ঠিক রাখতে হবে।’
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকার শুধু আমদানি-বিতরণ করলে হবে না। বেসরকারি খাতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। উভয় ক্ষেত্রে সমন্বয়টা জরুরি।
তিনি বলেন, আমাদের চালের যে চাহিদা প্রাক্কলন হচ্ছে, সেটা ত্রুটিপূর্ণ। উৎপাদনের তথ্যও ঠিক নেই। এজন্য খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা হলেও প্রচুর চাল আমদানি হচ্ছে। সত্যিকারের চাহিদা মেটাতে সেটা প্রয়োজন। প্রকৃত চালের ঘাটতির কারণে দাম বাড়ছে। সেটা ভোগাচ্ছে সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে যারা প্রান্তিক তারা চালের দামের জন্য কষ্ট পাচ্ছে বেশি।
স্বাধীনতার পর থেকে উৎপাদনের যে সফলতার কথা বলা হয়, তাতে মানুষের আরও অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে খাদ্যদ্রব্য পাওয়ার কথা। তথ্য বলছে, স্বাধীনতার আগে পূর্বপাকিস্তানে প্রতিবছর খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল গড়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন। হানাদারদের গণহত্যা ও তাণ্ডবের কারণে এদেশে ঘাটতি আরও বেড়ে ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে দাঁড়ায় ৩০ লাখ টন, যা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ। ৫০ বছরে কৃষির কল্যাণে সেই ঘাটতির বাংলাদেশ এখন বাড়তি খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী।
বেশ কিছু তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৭০-৭১ সালে দেশে মোট খাদ্যশস্যের উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ টন। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার কোটি ৫৩ লাখ টন। ১৯৭২ সালে যেখানে একজন মানুষ প্রতিদিন খাদ্য পেতেন (খাদ্যশস্যের প্রাপ্যতা) ৪৫৬ গ্রাম, তা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৬৮৭ গ্রাম।
এরপরও যখন দামের প্রশ্ন আসে তখন অজুহাত আসে খাদ্য সংকটের। প্রতিবছর থাকছে ঘাটতি, বাড়ছে দাম। মোটা চালের দামও থাকছে বলা যায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। আমদানিনির্ভরতাও এখনো কাটেনি।
মন্তব্য করুন