নূরুজ্জামান ফারুকী হবিগঞ্জ।
দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে হবিগঞ্জের অধিকাংশ নদনদী। জেলার উল্লেখযোগ্য ৫০টির বেশি নদনদীর মধ্যে বর্তমানে কোনোভাবে ৩০টি নদীর অস্তিত্ব নির্ধারণ করা গেলেও অস্তিত্বহীন প্রায় ২০ নদী। যেগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশ মৃতপ্রায়। নদীর দু’পাশে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। দখল আর দূষণের কবলে পড়ে চরম নাব্য সংকটে অস্তিত্ব হুমকির মুখে। একদিকে নদীর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে নদী হারাচ্ছে তার নাব্যতা। সত্তরের দশকে হবিগঞ্জে ৫০টির বেশি নদী ছিল। তবে এখন জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় আছে মাত্র ৩০টি নদীর নাম। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে হবিগঞ্জ থেকে প্রায় অর্ধেক নদীর নামই মুছে গেছে। অস্তিত্ব নেই বেশির ভাগ নদীর সঙ্গে জুড়ে থাকা শতাধিক খালের। এসব নদী ও খাল দখল করে গড়ে উঠেছে বসতি, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় স্থাপনা। দীর্ঘ সময় ধরে খনন না করায় সমতল ভূমিতে পরিণত হওয়া নদীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। যে ৩০টি নদী এখনও টিকে আছে সেগুলোও পরিণত হয়েছে খাল বা নালায়। সেই সঙ্গে নদী শাসনে মহাসংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে কুশিয়ারা, কালনী, খোয়াই, সুতাং, রত্না এবং করাঙ্গীর মতো বড় নদীগুলোও। এগুলোর দু’পাশে গড়ে উঠেছে বড় বড় স্থাপনা। দূষণ কবলিত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে এসব নদী। এক সময়ের খরস্রোতা শাখা বরাক নদীর নাম অজানা নয় কারোরই। এই নদীতে এক সময় চলাচল করতো লঞ্চ ও ট্রলার। নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এই এলাকার বাসিন্দারা। যে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ শহর। এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্যের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই নদী পথ। কালের পরিক্রমায় গেল ৪ দশকে এই জেলার অধিকাংশ নদীর মতো শাখা বরাকও হারিয়েছে তার যৌবন। দখল-দূষণের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে নদীটি এখন পরিণত হয়েছে মরা খালে।
সুতাং নদীর অবস্থা আরও ভয়াবহ। শিল্পবর্জ্যের দূষণে নদীটি এখন মৃতপ্রায়। দখলের কবলে বিলীনের পথে বাহুবলের করাঙ্গী ও মাধবপুরের সোনাই, আর শুঁটকি নদী। চরম সংকটে রয়েছে রত্না এবং হবিগঞ্জ শহরকে ঘিরে থাকা খোয়াই নদীটিও।
শাখা বরাক নদীপাড়ের আওড়া গ্রামের বাসিন্দা রমিজ আলী জানান, এই নদীতে বড় বড় লঞ্চ ও ট্রলার চলাচল করতো। দুই পাশে শত শত নৌকা বাঁধা থাকত। এসব নৌকা বিভিন্ন এলাকা থেকে মালামাল নিয়ে আসত নবীগঞ্জে। বরাকের পাড় ছিল জমজমাট ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। এখন নদীটি ছোট হয়ে গেছে। নদীর কিছু কিছু এলাকা দেখে মনে হবে সংকীর্ণ খাল। খোয়াই নদী পার্শ্ববর্তী নিউ মুসলিম কোয়ার্টার এলাকার বাসিন্দা অ্যাডভোকেট হাসবী সাঈদ চৌধুরী জানান, এক সময়ে খরস্রোতা খোয়াই নদীটি এখন অস্তিত্ব হারিয়ে সংকীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। ময়লা, আবর্জনার স্তূপ জমে এবং বিভিন্ন এলাকা ভরাট হয়ে যাওয়ায় নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত। দখলের কারণে নদী হারিয়েছে গতিপথ। একই এলাকার মামুন মিয়া জানান, নদীটির বিভিন্ন এলাকা দখল হয়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। এতে করে নদীটি মরতে বসেছে। স্থানীয় নদীগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। দেখা দেয় অকাল বন্যা। সুতাং নদীপাড়ের বাসিন্দা লিলু মিয়া জানান, এক সময়ের প্রমত্তা এই নদীটিকে এখন দেখলে মনে হবে খাল। দূষিত বর্জ্যে নদীর পানি কালো হয়ে গেছে। নদীর পানিতে যে দুর্গন্ধ, তা সাধারণের সহ্যের বাইরে। নদীর পানি পান করার ফলে মারা যাচ্ছে গবাদি পশু। এ নদীর পানি বর্তমানে কৃষি কাজে ব্যবহারের একেবারে অনুপযুক্ত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জের সহ-সভাপতি তাহমিনা বেগম গিনি বলেন, ‘নদী হলো জীবন্ত সত্তা। নদীকে টিকিয়ে রাখতে হবে। নদীরায় সবাইকে সচেতন হতে হবে। ময়লা-আবর্জনা না ফেলে নদীর গতিপথ স্বাভাবিক রাখা প্রয়োজন।’ এ সময় নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ ও দ্রুত খননসহ কার্যকরী পদপে নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, জেলায় প্রায় ৩০টি নদীর পরিচয় পাওয়া গেছে। অনেক নদীর দু’পাশে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠে ছোট নদীতে পরিণত হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় নদীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। প্রত্যেক উপজেলায় নদী চিহ্নিত করতে প্রশাসনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি নদী দখল মুক্ত করতে এবং নদীর সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে নদীর খনন ও উচ্ছেদ অভিযানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
মন্তব্য করুন