কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি:
বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে কুলাউড়ার হাজীপুর ইউনিয়নের বিতর্কিত সেই ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট বিভিন্ন অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে ওই চেয়ারম্যানকে অপসারণের সুপারিশও করা হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য তথ্যে জানা গেছে। গত ২৮ নভেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগ মৌলভীবাজারের (স্মারক নং ০৫.৪৬.৫৮০০.০১২.২৭.০০২.২২-৫৬৩) উপ-পরিচালক মল্লিকা দে স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে ইউপি’র চেয়ারম্যান ওয়াদুদ বখসের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর অনুলিপি কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরেও প্রেরণ করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের ওই পত্র এবং এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়; সরকারি সম্পদ আত্মসাৎ, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি, নির্বাচিত সদস্যদের সাথে খারাপ আচরণ, ক্ষমতার অপব্যাবহার ও অন্যান্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে ইউপি চেয়ারম্যান ওয়াদুদ বখসের বিরুদ্ধে চলতি বছরে ১৬ আগস্ট এক সভার আয়োজন করেন বিষয়ে হাজীপুর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান নূর আহমদ চৌধুরী বুলবুলসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডের ৭ জন সদস্য। ওই সভায় তার অপকর্ম ও অনৈতিক আচরণের প্রতিবাদে অনাস্থা প্রস্তাব গ্রহণ করে ২৮ আগস্ট মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়। এতে মেম্বারগণ চেয়ারম্যান ওয়াদুদ বখসের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির সুস্পষ্ট ১১টি অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ও সরকারের উর্দ্ধতন বিভাগেও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন থেকে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট খাদিজা তাহিরাকে তদন্তপূর্বক বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সরেজমিন তদন্ত করে চেয়ারম্যান ওয়াদুদ বখসের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের সত্যতা পেয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। তদন্ত কর্মকর্তা ওই প্রতিবেদনে তাঁকে (চেয়ারম্যান ওয়াদুদ বখস) অপসারণের সুপারিশও করেছেন।
তাছাড়া ওই পত্রে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) (সংশোধন) আইন, ২০১০ এর ৩৪ এর বিধিমতে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের লক্ষ্যে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে হাজির হয়ে বক্তব্য প্রদান করতেও বলা হয়।
জানা গেছে, হাজীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওয়াদুদ বখস গত বছরের ২৮ নভেম্বর প্রথমবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতা গ্রহণ করেই অনেকটা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তিনি নিজের মনগড়া ইউনিয়ন পরিষদ পরিচালনা করেন। ইউপি সদস্যদের সাথে সমন্বয় না করেই নিজের ইচ্ছেমত জন্মনিবন্ধনের অতিরিক্ত ফি আদায়, আদায়কৃত ফি’র টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে নিজের পকেটে রেখে খরচ করা, ইউপি সদস্যদের সাথে অশালীন কথাবার্তা, সেবা গ্রহীতাদের সাথে খারাপ আচরণ, তার নির্দেশে সামাজিক বনায়নের গাছ কর্তন, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, চাঁদাবাজিসহ অসংখ্য অভিযোগে ইউনিয়নের সাধারণ লোকজনের ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। ফলে তার প্রতি সাধারণ মানুষের অনেকটা নাবিশ্বাস উঠে। মাত্র ১ বছরের মাথায় তার বিরুদ্ধে আনীত এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতাও পাওয়া যায়।
ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র জানায়, দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি মনগড়া নাগরিক সনদ, জন্মসনদ ও ট্রেড লাইসেন্সেসহ সকল সনদে সরকার নির্ধারিত ফি’র অতিরিক্ত চার থেকে পাঁচশ টাকা নির্ধারণ করেন। এসব ফি’র টাকা তিনি কোন রশীদ ছাড়া নিজ হাতে গ্রহণ করতেন। তার কাছে টাকা না দিলে কোন সনদে তিনি স্বাক্ষর দিতেন না।
স্থানীয়রা আরো জানান, এসব অপকর্ম, ইউনিয়নের নাগরিকদের হয়রানি, ৭ ইউপি সদস্যদের সাথে অসাদাচরণের প্রতিবাদে এলাকাবসীর আয়োজনে ওই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মানববন্ধন হয়েছে। ২১ সেপ্টেম্বর হাজীপুর ইউনিয়নের কটারকোনা বাজারে ঘণ্টাব্যাপী এই মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনের খবর পেয়ে তিনি আরো ক্ষেপে যান। সেবা গ্রহীতারা ইউনিয়ন পরিষদে গেলে তাদের উপর আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। প্রকাশ্যে তাদের গালি-গালাজ করেন। একপর্যায়ে স্থানীয় পীরেরবাজারে চেয়ারম্যান অনুসারীরা ২৭ সেপ্টেম্বর এক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করলে সেই সভায় চেয়ারম্যান ওয়াদুদ বখস তার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মৌলভীবাজার সদর আসনের এমপি, জেলা প্রশাসক ও কুলাউড়ার ইউএনওকে নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দেন। যা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তার বিরুদ্ধে তখন সমালোচনার ঝড় ওঠে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয়রা জানান, ৫ জুন মুরইছড়া বনবিটের আওতাধীন মনু তিলকপুর রাস্তা থেকে মজমপুর এবং হাজীপুর রাস্তা থেকে সোনা দিঘিরপাড় রাস্তায় আকাশমনি ও বেলজিয়াম প্রজাতির অন্তত ৫০টি গাছ তাঁর নির্দেশেই কাটা হয়।
স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে সম্প্রতি হাজীপুর ইউনিয়নের প্রাচীনতম কানিহাটি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান গেইট থেকে দাতা সদস্যদের নাম অপসারণ করেছেন চেয়ারম্যান ওয়াদুদ বক্স। তিনি ওই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির বর্তমান সভাপতি। বিদ্যালয়ের প্রধান গেইটে তিনি প্রকল্পসহ নিজের নাম ও পদবীর একটি ফলক লাগিয়েছেন। এ ঘটনায় এলাকাবাসীসহ বিদ্যালয়ের প্রাক্তণ ছাত্ররা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন।
প্রেরক-
মন্তব্য করুন