ডেস্ক রিপোর্ট। দি সিলেট পোস্ট।
এ দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ পড়েছে উভয় সংকটে। তারা না পারে রাস্তায় লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য সংগ্রহ করতে, না পারে ত্রাণের সাহায্য নিতে, না পারে বয়স্ক ভাতার তালিকায় নাম যুক্ত করতে কিংবা না পারে স্বপ্নিল আয়েশি জীবনের আশায় দেশের বাইরে যেতে।
সরকার থেকে সুযোগ-সুবিধা যা পাওয়ার এর অধিকাংশটাই পায় বিত্তবানরা, আর কিছুটা বরাদ্দ থাকে দরিদ্র শ্রেণির জন্য। নিম্ন মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্তের জন্য বলা যায় কিছুই বরাদ্দ থাকে না। এ শ্রেণিটার ওপর আলাহই একমাত্র ভরসা।
বাংলাদেশ যখন মধ্য-আয়ের দেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখনই শুরু হলো রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ। বেড়ে গেল দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি বিদ্যুৎ আর জ্বালানি তেলের দাম। ঘরে-বাইরে প্রতিটি কর্মকাণ্ডে প্রয়োজন বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাস। বিদ্যুতের চাহিদা পূরণের জন্য বেশ কিছুদিন থেকেই শুরু হয়েছে লোডশেডিং। যথাযথ বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে শিল্প-কলকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি পোশাকশিল্প চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না। বিদ্যুতের অভাবে অনেক কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে।
আমাদের দেশে বিদ্যুৎ, গ্যাস খাতে প্রচুর অপচয় ও দুর্নীতি হয়। বিশেষ করে সরকারি অফিসে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অধিকাংশই রুমে উপস্থিত না থাকলেও লাইট, ফ্যান কিংবা এসি চলতে থাকে। অথচ নিজের বাসায় এটি হওয়ার কোনো জো নেই। শুধু তাই নয়, অনেক রাস্তায় রাতে জ্বালানো বাতি বেলা বাড়লেও আর নেভে না। দোকানপাট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অকারণে আলোকসজ্জার ছড়াছড়ি।
সরকারি অনুষ্ঠানগুলোয় অহেতুক বিশাল আকারের অর্থের অপচয় করা হয়। কারণ জাতীয় সম্পদ/সরকারি সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা একেবারেই উদাসীন। গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। ব্যক্তিগত কাজে গাড়ি ব্যবহার করলেও অনেক সময় সেটি হয়ে যায় সরকারি কাজ। বিদ্যুৎ আর গ্যাসের অবৈধ সংযোগের কথা দেশবাসী খুব ভালো করেই জানেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারী সৎ উপায়ে ঢাকা শহরে গাড়ি-বাড়ির মালিক হতে পারে না। প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তা যে স্কেলে বেতনভাতা পান, তাতে দুর্মূল্যের এ বাজারে ঘরভাড়া, খাদ্য, চিকিৎসা ব্যয়, সন্তানের লেখাপড়ার ব্যয় মেটাতেই নাভিশ্বাস ওঠে, সামাজিকতা রক্ষার কথা তো বাদই দিলাম।
অথচ অনেক কর্মচারীরও অঢেল টাকা, গাড়ি-বাড়ির খবর আমরা পত্রিকান্তরে জানতে পাই। দেখতে পাই বড় বড় হেডলাইনে লেখা ‘সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড়’ (যুগান্তর, ১৭.০৬.২২)। দেশের ব্যাংক খালি হচ্ছে আর সুইস ব্যাংকে জমছে টাকার পাহাড়। ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকে টাকা ছিল ৫ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালে এ টাকার পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের বার্ষিক ব্যাংকিং পরিসংখ্যান ২০২২ থেকে এ তথ্য জানা যায়। পত্রিকান্তরে আরও জানা যায়, এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। অর্থনীতিবিদদের মতে, বিভিন্ন কারণে বিত্তবানরা দেশে টাকা রাখা নিরাপদ মনে করছেন না। ফলে বিভিন্ন উপায়ে টাকা পাচার হচ্ছে। ঋণের নামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা, বিভিন্ন প্রকল্প থেকে টাকা চুরি, ঘুস, দুর্নীতি করে এ টাকা পাচার করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে-বিদেশে অর্থনৈতিক মন্দা চললেও বিগত তিন মাসে দেশের ব্যাংকগুলোয় কোটিপতি হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়েছে ১ হাজার ৬০৩টি এবং ঋণ হিসাব বেড়েছে ২৪৮২টি। বিগত ৬ বছরে দেশ থেকে ৪ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) কর্তৃক এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। জিএফআই-এর তথ্যানুসারে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে ২০০৯ সাল থেকে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫১২ কোটি, ২০১০ সালে ৬৮৪ কোটি, ২০১১ সালে ৮৭৩ কোটি, ২০১২ সালে ৭৬৪ কোটি, ২০১৩ সালে ৯৩৪ কোটি, ২০১৫ সালে ১ হাজার ১৮৭ কোটি ডলার।
এই যে বিশাল আকারের অর্থ দেশ থেকে প্রতিবছর পাচার হচ্ছে, এ ব্যাপারে কোনোরকম ব্যবস্থা তো নেওয়া হচ্ছেই না, উলটো অর্থ পাচারকারীদের প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহ দেওয়ার প্রস্তাবও হয়েছে। জনগণের টাকা পাচার করে দেশকে দেউলিয়া বানানোর চেষ্টায় যারা রয়েছে, তাদের শাস্তির আওতায় এনে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার সময় এসেছে।
আমরা এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ খেয়ে না খেয়ে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে জীবনটাকে দুর্বিষহ অবস্থায় নিয়ে যাব আর একটা শ্রেণি দেশের টাকা লুটপাট করে পাচার করে নাকে তেল দিয়ে আরাম আয়েশে জীবন কাটাবে, এটি মেনে নেওয়া যায় না।
এসব দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার বারবার নিরীহ মধ্যবিত্ত গোষ্ঠীটার ওপর চড়াও হচ্ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণিটার অধিকাংশই, বিশেষ করে চাকরিজীবীরা তাদের জীবনের শেষ সঞ্চয় দিয়ে নিরাপদ এবং নিশ্চিন্ত জীবনের জন্য এবং ঝুঁকি এড়াতে সঞ্চয়পত্র কিনে রাখে। এটাই তাদের আয়ের একমাত্র ভরসা। বিগত দু/তিন বছর ধরে এ সঞ্চয়পত্রের মুনাফা সরকার কমিয়ে তাদের বিপাকে ফেলেছে। এ শ্রেণিটা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, চিকিৎসা ব্যয়, শিক্ষার উপকরণ ব্যয় বৃদ্ধি, বাড়িভাড়া বৃদ্ধিতে কীভাবে তাদের প্রাত্যহিক দৈনন্দিন জীবননির্বাহ করছে, সে খবর কেউ রাখছে না।
এ নিয়ে বহু লেখালেখি, আবেদন-নিবেদন করেও কোনো লাভ তো হয়নি, উলটো ১৯ জুলাই পত্রিকান্তরে জানা গেল সঞ্চয়পত্রের সুদের হার আবারও কমছে। শুধু তাই নয়, সঞ্চয়পত্র বিক্রি পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে অর্থ বিভাগ। আগামী তিন বছরে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা বিক্রি কাটছাঁট করা হবে বলে জানা যায়। সঞ্চয়পত্রের সুদ পরিশোধ ব্যয় কমাতে এ সিদ্ধান্তের দিকে যাচ্ছে সরকার।
বস্তুত দেশের বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠীর কথা সরকার ভাবছে না। যারা ঋণখেলাপি হয়ে বহাল তবিয়তে আছেন, ব্যাংক খাত এবং দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজাচ্ছেন, তাদের ব্যাপারে সরকার নির্লিপ্ত। বারবার খড়্গ নেমে আসে এ মধ্যবিত্ত আর নিম্ন বিত্ত শ্রেণিটার ওপর। কারণ বিত্তবানরা তাদের বিত্তবৈভব দিয়ে সবকিছু ম্যানেজ করে নিতে পারে। এরা ট্যাক্স ফাঁকি দিতে পারে। দেশের সম্পদ বাইরে পাচার করতে পারে। এদের টিকিটি কেউ স্পর্শ করতে পারে না। তাই তো তারা এতটাই বেপরোয়া।
দেশের অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে এ মুহূর্তে দেশের পাচারকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা ফিরিয়ে এনে দেশের অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার পাশাপাশি জনগণকে একটু শান্তি আর স্বস্তিতে রাখার জন্য সরকারকে আরও বেশি আন্তরিক ও উদ্যোগী হতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারকে কঠোর হাতে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ, প্রতিটি অফিস-আদালতে কৃচ্ছ্রসাধন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রক্ষার্থে বিদেশভ্রমণ বন্ধ, খুব বেশি প্রাণসংশয় অবস্থা না হলে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণে নিরুৎসাহিত করাসহ জাতীয় সম্পদের অপচয় রোধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। তা নাহলে মধ্য-আয়ের দেশে যাওয়া দূরের কথা, বর্তমান সংকটময় অবস্থা থেকে উত্তরণই কঠিন হয়ে যাবে, এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়।
মনজু আরা বেগম : অথনীতি বিশ্লেষক; সাবেক মহাব্যবস্থাপক, বিসিক
মন্তব্য করুন