মাহবুবুল আলম
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী এমপির আত্মীয় স্বজনদের ক্ষমতার দাপট দেখানো নতুন কোনো ঘটনা নয়। অতীতের এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী আমরা। তবে এবারের ক্ষমতার দাপট দেখালেন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রী।
এই ঘটনা এখন টক অব দ্যা কান্ট্রি।
সম্প্রতি রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিনা টিকিটে পাবনা থেকে ঢাকাগামী তিন যাত্রীকে জরিমানা করা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। বিনা টিকিটে ভ্রমণের জন্য তিনজনের কাছ থেকে জরিমানাসহ ভাড়া আদায় করেন ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরিদর্শক (টিটিই)। এই ঘটনার জেরে টিটিই মো. শফিকুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
পাশাপাশি এই টিটিইকে ডিসিও পাকশী দফতরে ব্যাখ্যার জন্য আজ তলব করা হয়েছে। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন ও তার স্ত্রী শাম্মি আক্তার মনি এখন আলোচনায়। যদিও সমালোচনার মুখে রবিবার এই আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে দেশের মানুষ জেনে গেছে যে, বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণের কারণে মন্ত্রীর স্ত্রীর তিন আত্মীয়কে চ্যালেঞ্জ করায় চাকরি থেকে বরখাস্ত হন টিটিই। এনিয়ে যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। টিটিইকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার ঘটনায় মন্ত্রীর স্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার মুখরোচক সমালোচনা চলে সর্বত্র। ওই যাত্রীদের সঙ্গে নিজের আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই বলেও দাবি করেছিলেন রেলমন্ত্রী নূূরুল ইসলাম সুজন। চাপে পড়ে পরবর্তীতে স্বীকার করতে বাধ্য হন।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে , ‘ এটা দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ৷ সব সময়ই যারা যখন ক্ষমতায় থেকেছেন তারা দাপট দেখিয়েছেন৷ এর মাধ্যমে প্রশাসনের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্যও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে৷ ফলে যারা দাপট দেখান তাদের সুরক্ষাও দেয়া হয়েছে৷ এটা এক ধরণের নিয়ন্ত্রণ কৌশল৷’’…এখন রেলের ঘটনায় ক্ষমতার অপব্যবহারের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে তো ক্ষমতার এই অপব্যবহার আরো বাড়বে৷ দায়িত্ব পালন করায় টিটিই’র তো পুরস্কৃত হওয়ার কথা ছিলো৷ হয়েছে উল্টোটা৷ এই সংস্কৃতি তো স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার বিষয়গুলো বিদায় করে দেবে”।
অন্যদিকে অতি সম্প্রতি পটুয়াখালীর সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য কাজী কানিজ সুলতানা হেলেনের ছেলে ও তার সঙ্গীরা পায়রা সেতুর টোল প্লাজার কর্মচারীদের মারধর করার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনা নিয়েও সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। জানা গেছে, এমপি পুত্র তাজ তালুকদার তার স্ত্রী এবং সঙ্গীদের নিয়ে টোল ছাড়াই সেতু পার হতে চেয়েছিলেন। দায়িত্বরত কর্মচারীরা সেটা হতে দিতে না চাইলে তাদের মারধর করা হয়। এরপর টোল না দিয়েই তারা চলে যান।
তার আগে ঢাকার সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের পুত্র ইরফান সেলিমের দাপটের খবর এসেছিল গণমাধ্যমে। ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর রাতে তিনি ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধর করে কারাগারে গেলেও তাকে বেশিদিন আটকে রাখা যায়নি। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও হত্যা চেষ্টার অভিযোগে তখন তিনটি মামলা হলেও এরইমধ্যে অস্ত্র ও মাদক মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
আর সম্প্রতি তার বাবা সংসদ সদস্য হাজি সেলিম ১০ বছরের চূড়ান্ত দণ্ড মাথায় নিয়ে আত্মসমর্পণের বিষয়ে আদালতের আদেশ থাকা সত্যেও বিনা বাধায় থাইল্যান্ড থেকে ঘুরে আসেন। পুলিশ বা ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ কেউ তাকে আটকায়নি।
সরকার দলীয় মন্ত্রী এমপি ও নেতাকর্মীদের ক্ষমতার দাপটে অতিষ্ঠ সড়ক যোগাযোগ মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের ক্ষমতার দাপট না দেখানোর আহবান জানিয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ মানে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সৃষ্টির শ্লোগান। দুঃসময় মোকাবেলার নাম আওয়ামী লীগ। সব দুঃসময়ের বিরুদ্ধে দুর্যোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে আওয়ামী লীগ আজ ক্ষমতায়। তাই ক্ষতার দাপট না দেখানোর হুশিয়ারি উচ্চারন করেছেন।
সম্প্রতি রেলমন্ত্রীর স্ত্রী যে অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্ম দিয়েছে তা রেলের উন্নয়নে বর্তমান সরকারের সব
সাফল্যকে ম্লান করে দিয়েছে অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই একটা পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয় হিসেবে রেলপথ মন্ত্রণালয় যাত্রা শুরু করে। এরপর বিগত ১২ বছরে রেলের উন্নয়নে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার। নেওয়া হয়েছে বহু মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। ২০১২ ও ২০১৬ সালে দুই দফায় রেলের যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এরপরও রেলের কপাল থেকে লোকসানি সংস্থার তকমা দূর হয়নি।
আর সম্প্রতি টিটিই বরখাস্তের ঘটনাটি দ্বারা রেলের অতি উৎসাহি কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহারের নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবেই গণ্য হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলে বিপুল বিনিয়োগের পরও রেলের লোকসানের পাল্লা ভারী হওয়ার পেছনে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কেনাকাটায় দুর্নীতি, অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতিই মূল কারণ। রেলের তোষামোদকারী কর্মকর্তা গিরগিটি সেজে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় টিটিইকে বরখাস্ত যে অনাকাঙ্খিত ঘটনার জন্ম দিয়েছেন এর দাগ সহজেই মুছে যাবার নয়। সময় সংকীর্ণ। অতএব সাধু সাবধান।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট, শিক্ষাবিদ ও গবেষক
মন্তব্য করুন