মাহবুবুল আলম
রমজান আসতে বেশি দেরি নেই। সপ্তাহখানেক পরেই পবিত্র এই মাসের শুরু। আর এই মাসকে সামনে রেখেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করেছে আমাদের দেশের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। নগরীসহ দেশের প্রতিটি হাট-বাজারে এর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। সব থেকে বেশি প্রভাব পড়েছে তেল, চিনি, মাংস, মসলা, আদা, রসুন, ছোলা,পেঁয়াজেরর দামে। চালের দামও বাড়ছে হুহু করে। সারাদেশে শক্তিশালী কিছু সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি রোযার নিত্যপন্যের বাজার। রোযাকে সামনে রেখে এসব পণ্যের দাম বাড়েই চলেছে। সাধারণের মনে প্রশ্ন সিন্ডকেটের কাছে সরকার কি অসহায়, তাই যদি না হবে তবে সরকার কেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির রোধ করতে পারছে না!
দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে আলোচিত এবং সমালোচিত বিষয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক এবং আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে অস্থিরতা এখন সারা বিশ্বেই। সেই করোনা সংক্রামণের শুরু থেকে যে দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি শুরু হয়েছে তা কোনোভাবেই থামছে না। এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
এখানে জ্বালানি তেল ছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্য এমনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে যে আগে যে পরিমাণ মোদীমাল ১০০০ টাকায় ক্রয় করা যেত, এখন তা ক্রয় করতে লাগে ১৫ থেকে ১৬’শ থেকে টাকায়। শুধু তাই নয়, এই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যথেষ্ট ছলচাতুরীও আছে। অনেক ক্ষেত্রে আগের মূল্য ঠিক রেখে দ্রব্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় পঁচিশ শতাংশ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারি বিপনন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে তেল, পেয়াজ, চিনি ,ছোলা, মশুরের ডাল, ও খেজুর বিক্রির কার্যক্রম শুরুর পাশাপাশি নানান কৌশলী পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও তার সিকিভাগ বাস্তবায়ন করা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে খোদ বাজার নিয়ন্ত্রকরাই সন্দেহের দোলাচলে আছেন। বাজার পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেটের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহল ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কমূকতারাও জড়িত। তাই প্রতিবছরই রমজানের সময় এধরনের উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত সিন্ডিকেট ভাঙ্গা সম্ভব নয়। বরং এ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার কারণে হযবরল পরিস্থিতির মাঝে নিত্যপণের মূল্য আরো একধাপ বেড়ে যায়।
নানান কারসাজির মাধ্যমে একদিকে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট অতি মুনাফা করছে, অন্যদিকে এর শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষ। ব্যবসা-বণিজ্য তথা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রতি ক্ষেত্রেই সিন্ডিকেটের আস্ফালন লক্ষণীয়। ফলে এই সিন্ডিকেট চক্রটি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এরা ইচ্ছেমতো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে অনায়াসে অন্যায্যভাবে বিপুল মুনাফা লুটে নিচ্ছে।
পণ্যের আমদানি ও বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করতে আমদানিকারকদের ভোগ্যপণ্যের এলসি মার্জিন ও আমদানি শুল্ক কমাতে সহায়তা প্রদানে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনাসহ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আরও কার্যকরী ভূমিকা নিতে হবে। আমদানিনির্ভর সব নিত্যপণ্যের মজুদ মনিটরিংয়ের আওতায় এনে সরকারিভাবে মজুদ বাড়াতে হবে। নিয়মিতভাবে বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি মজুদকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
দেশের সব বাজারে নিয়মিত মূল্যতালিকা হালনাগাদকরণ ও প্রদর্শন কার্যক্রম নিশ্চিতের পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অসৎ ব্যবসায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পণ্য সংকটের অজুহাতে আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা যেন পণ্যের দাম বাড়াতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
মানুষ কনে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পরিকল্পিত কারসাজিতে পবিত্র রমযান মাসে রোজাদারদের অসহনীয় ভোগান্তি পোহাতে হবে। দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা দেশের নিম্ন ও মধ্য আয়ের জনগণ। মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেঁচে থাকার তাগিদে আজ আত্মপরিচয় ভুলে টিসিবির ট্রাক থেকে স্বল্প মূল্যে পণ্য সংগ্রহে নিম্নবিত্তের সাথে একই কাতারে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে জনগণকে আত্মমর্যাদাসহ বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হলে সরকার ভবিষ্যতে গণরোষে পতিত হতে পারে। মজুদদারি ও কালোবাজারি বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি গুজবের মাধ্যমে কেউ যেন বাজার পরিস্থিত অস্থিতিশীল করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের এমন ভয়াবহ ও অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি এবং মানুষের নাভিশ্বাসের বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘একমাত্র লুটপাটকারী কিছু লোক ছাড়া সমাজের সর্বস্তরের মানুষ খারাপ অবস্থায় আছেন। তাদের যে আয় তা দিয়ে সংসার কোনোভাবেই চলছে না। এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই চলতে পারে না। সরকারকে রেশনিং প্রথা আবার চালু করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যদি সরকার কমাতে না পারে, তাহলে বাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির সরকারি ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ছাড়া মানুষ বাঁচবে না। ‘
সরকার যেসব পণ্যের মূল্যতালিকা নির্ধারণ করেছে সেসব পণ্যের দাম যেন বিক্রেতারা নিজেদের ইচ্ছামতো বাড়াতে না পারে সে বিষয়টি কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে। পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, রমজানে নিত্যপণ্যের চাহিদাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী মজুদ করে বা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাজারকে অধিকতর অস্থিতিশীল করে তোলে। তাই এ বিষয়ে আগে থেকেই যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
করোনা মহামারীতে এমনিতেই মানুষের আয় কমে গিয়ে এখন মানুষ পুরোদস্তুর হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় নিত্যপণ্যের দাম মানুষের নাগালের মধ্যে আনতে না পারলে এবং সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে মানুষের দুর্দশা আগামীতে আরও বাড়বে। যার দায় সরকার সংশ্লিষ্টরা কিছুতেই এড়াতে পারবে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এমনই একটি ইস্যু যার বিস্ফোরণ যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে।
লেখক: কবি-কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট ও গবেষক।
মন্তব্য করুন